ইসলাম

সমাজ, বিয়ে এবং নারী

1054_310588_smna.jpg

পরিবারের মধ্যে থেকেও নিরাপদ নয় কেন একটি কিশোরী মেয়ে? সবার সমস্যার কারণগুলো সবারই জানা উচিত যাতে একই সমস্যা বারবার সৃষ্টি না হয়। পরিচয় গোপন রেখেও মেয়েরা তাদের সমস্যার কথাগুলো আলোচনা করতে পারে, জানাতে পারে, সমাধান পেতে পারে সেরকম প্ল্যাটফর্ম খুব কমই আছে। বইয়ে গল্পাকারে কিছু পড়লে জীবনবিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হয় আজকাল। তবে সোস্যাল মিডিয়ায় লাইভে এসে জানালে কিংবা বায়োপিক মুভি দেখলে তখন জীবনঘনিষ্ঠ কোনো ঘটনা মনে হয়; মনে রাখার মতো ব্যাপার মনে হয়। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের মস্তিষ্ক বিয়োগান্তক ঘটনা বা দুর্ঘটনা যতটা যত্নের সাথে জমিয়ে রাখে ঠিক ততটাই অযত্নে ভুলে যায় আনন্দের কোনো ঘটনা বা স্বাভাবিক কোনো ঘটনা। ঠিক যতটা সহজে মনে আছে, পাকিস্তানের নারীশিক্ষার পক্ষে লড়াকু মেয়ে মালালার মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা কিংবা নির্ভয়া মেয়েটির দিল্লিতে চলন্ত বাসে গণধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনা; ঠিক ততটা সহজেই মনে থাকেনি, কবে মালালা সুস্হ হয়েছিল কিংবা নির্ভয়া লাইফ সাপোর্ট নিয়ে কতদিন লড়াই করে বেঁচেছিল।

তাই যে সব নারীর জীবনের বিয়োগান্তক কিংবা আনন্দের কথা মনে ও মস্তিষ্কে দীর্ঘসময় ধারণ করে আছি এবং কিছু না কিছু শিখতে পেরেছি সেসব নারীদের কথাই আজ লিখবো বলে ভেবেছি অন্য নারী পাঠকদের জন্যঃ

সমাজের প্রশ্ন ও চাপের মুখে এইচ.এস.সি না পেরোতেই সম্বন্ধ করে মেয়ের বিয়ে দিলেই কি একটি মেয়ের সম্মান রক্ষা হয়? পাত্রের সব রকম খোঁজ খবর নিয়ে কচি বয়সে মেয়েকে পাত্রস্থ করেই কি শেষ রক্ষা হয়? কিংবা বিয়ে দিয়েই কি কন্যা সন্তানের প্রতি পরিবারের সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? পিতামাতার বাড়িতেই যখন একটা বয়সের পর একটি মেয়ে অনভিপ্রেত তখন শ্বশুরবাড়িতে কতটা অভিপ্রেত হতে পারে, আমাদের বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থায় তা কি সহজেই অনুমেয় নয়?

খুব সম্প্রতি চট্টগ্রামের দু’টি কিশোরী মেয়ের পালিয়ে যাওয়ার খবরটা যারা দেখেছেন তাদের কাছে বুঝতে সহজ হবে, আজকে যে বিষয় নিয়ে লিখছি। অল্পবয়সে বিয়ে এড়াতে মাসব্যাপী উধাও হয়ে থাকা মেয়ে দু’টো অচেনা শহরে গিয়ে কাজ খুঁজে এবং জীবন চালানোর চেষ্টা করে।

বাড়ি খোঁজার জন্য এবং সে বাড়ি ভাড়া করে দু’জনে মিলে পুরুষের সাহায্য ছাড়া থাকা ও আত্মরক্ষার জন্য পুরুষের বেশ ধরা ইত্যাদি বহু কিছু করেও শেষ রক্ষা হয়নি তাদের। র্যা ব ও পুলিশের কাছে ধরা পড়ে যায় একমাসের মধ্যে; কারণ র্যা ব তাদেরকে খুজঁছিল পরিবারেরই অভিযোগে; র্যা ব ও প্রশাসন উদ্ধারকৃত কিশোরী মেয়ে দু’টোকে পরিবারের কাছেই আবার ফিরিয়ে দেয়। আবারও একই পরিবেশ, মানুষ, প্রশ্ন ও একই সমাজে ফিরে গিয়ে কি রাতারাতি বদলে যাবে পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি? বদলে যাবে মেয়ে দু’টোর ভাগ্য?

পুরুষের পোশাক পরে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে কাজ খুঁজেছে মেয়েগুলো এবং পুরুষের বেশে কাজ করে সমাজের কাছে রীতিমতো প্রশ্ন রেখে গেলো ওরা- সমাজ কি শুধু পুরুষকেই সুরক্ষা দেয়? নারী তার স্বাভাবিক পোশাকে বা শারীরিক গঠন নিয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার অধিকার রাখে কি? একজন কর্মক্ষম নারী কোনো পুরুষের সাহায্য ছাড়া একা একটি বাসা ভাড়া করে থাকতে পারে কি? স্বামী বা ভাই কিংবা বাবা এই চরিত্রগুলো তৈরি করে তাদেরকে সঙ্গী করে তবেই বাসা ভাড়া করতে পেরেছে এই মেয়ে দু’টো। আজকের এই সময়ে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ভিন্ন হওয়া উচিত ছিল কিন্তু তা হয়নি। কারণ নারীর প্রতি অনাস্থা বা নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ না থাকা এই সমাজের কাছে- এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় কি?

কোনো মা যখন তার মেয়েকে উপদেশ দিচ্ছেন, “এখনই বিয়ে না করলে সন্তানধারণ করবার বয়স কমে যাবে” ঠিক তখন সেই মেয়েটি হয়তো ভাবছে, “এই সময়ে বিয়ে নামক দায়িত্বের এই সম্পর্কে জড়ালে বিদেশে গিয়ে আমার পি.এইচ.ডি’টা শেষ করা হবে না” কিংবা “সামনে প্রমোশন হলে বাইরে ট্র্যাভেল করার বিষয়টা থাকবে- সেটা কিভাবে নেবে আমার নতুন জীবনসঙ্গী- অনেক এ্যাডজাস্টমেন্টের ব্যাপার। কাজেই নতুন এই সম্পর্কের জন্য এখনও তৈরি না আমি।”

খুব উচ্চশিক্ষিত পরিবারেও যদি একটি মেয়ের বিয়ে হয় সেই পরিবারে থাকা সমবয়সী নিজ কন্যাসন্তান এবং পুত্রবধুকে পৃথকভাবেই দেখা হয়। যোগ্যতা থাকলেও বিয়ের পর সম্পর্কের উপর ভিত্তি করেই একটি মেয়ের প্রতি আচরণ নির্ধারিত হয়। অথচ সমান সুযোগ করে দিলে বউ এবং কন্যা দু'জনেই দু’টি ভিন্ন সংসারে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করতে পারে। তাতে কিন্তু সচ্ছলতা বাড়ে বই কমে না সংসারে।

একটি মেয়ের জন্ম দিয়ে কোনোরকম লেখাপড়া শিখিয়ে বিয়ে দিয়ে মেয়ের প্রতি দায়িত্ব শেষ করতে চায় কোন ধরনের পরিবারের বাবা মা? সংসারে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা থাকলে একজন শিক্ষিত মেয়ে কি নিজে কাজ করে নিজের খরচ চালিয়ে নিতে পারে না? পারে। তবে সেখানেও কিন্তু পরিবারের অনুমতি লাগে। বাবার বাড়িতে অনুমতি না মিললে পরবর্তীকালে লাঞ্ছনা অবশ্যই মিলে যায় স্বামীর বাড়িতে বা শ্বশুরবাড়িতে।

বিয়ের পর সন্তান লালনপালনে ব্যস্ত রাখলে বাইরে কাজ করার সুযোগ পাবে না। অর্থ উপার্জন না করতে দিলে এবং অর্থের সাহায্য না পেলে স্বামীর প্রভুত্বকে স্বীকার করে নিয়ে মুখ বুজে বাড়ির ঘরকন্নার কাজে মন দেবে কিংবা সন্তান দেখাশোনা করবে- এমনটাই ভাবতে শেখানো হয় একান্নবর্তী বাড়ির পুরুষকে, যে পুরুষের রোজগারের উপর হয়তো নির্ভরশীল বাবা- মা, ভাইবোনসহ গোটা পরিবার। নারীর হাতে অর্থ আসলে তার চিন্তার স্বাধীনতা আসে এবং পরিবারে মতামত ব্যক্ত করার যোগ্যতাও তৈরি হয় যা খুব সহজে পরিবারের বাকি সদস্যরা মেনে নিতে প্রস্তুত থাকে না। এই রকম অবস্থা খুব কম সংখ্যক পরিবারেই দেখা যায় যেখানে উপার্জনক্ষম ভাই ও ভাবিকে সমান গুরুত্ব দেয়া হয়।

উপার্জন না থাকলে একজন স্ত্রী তার স্বামী অন্য নারীতে আসক্ত হলেও সেই অন্যায় মেনে নিতে বাধ্য হয়। বাবার বাড়ি ফিরে যাবার বা সেখান থেকে প্রাথমিক কোনো সাপোর্টের পথও আগেই বন্ধ হয়ে যায় যদি সেই নারীর সন্তান থাকে। “মেনে নাও। আমিও তোমার বাবার অনেক অন্যায় মেনে নিয়েই তোমাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে চল্লিশ বছর ধরে তার সংসার করছি। তোমার সন্তানদেরও বাবার প্রয়োজন আছে। তাই বলছি মেনে নিতে শিখ!” মায়ের মুখ থেকে এরকম কথা শোনার পর নিরুপায় হয়ে হয়তো কোনো মেয়ে পাঁচতলা থেকে লাফিয়ে পরে নিজের জীবন শেষ করে। মাত্র কয়েক মাস আগেই আইনবিদ ইভানার মৃত্যু (২২ সেপ্টেম্বর ২০২১) ঠিক একই কারণেই ঘটেছিল। সেই মায়ের মেয়ে যেন নতুন অধ্যায় তৈরি করে দিয়ে গেছে বর্তমান এই সভ্যতায়।

এমন মা’দের কাছে আমার প্রশ্ন, কেন মনে হলো না আপনার, আপনি এবং আপনার মেয়ে দু’জন ভিন্ন দু’টো মানুষ? দু’জনের মানিয়ে নেয়ার বা মেনে নেয়ার ক্ষমতা ভিন্ন। জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। কেন চাপিয়ে দিলেন নিজের মেয়ের উপর নিজের যাপিত লাঞ্ছিত জীবনের শাপ?

ঠিক যেদিন, মহাকাশে এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় ও উন্নত স্পেস টেলিস্কোপ যাত্রার খবরটা দেখছি এবং সেই সাথে কানাডার বাঙালী বংশোদ্ভূত নাসার গবেষক লামিয়া মওলা’র চৌকস হাস্যোজ্জল সাক্ষাৎকার দেখেছি, সেদিনই দেখেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃত্যকলা বিভাগে পড়ুয়া মেঘলা’র অপমৃত্যুর খবর। মনে হচ্ছিল মেঘলাও কি এমন কিছু করে দেখাতে পারতো না ওকে বাঁচার সুযোগ দিলে? উন্নত দেশে জন্মালে? অথবা সভ্য পরিবারে বিয়ে হলে? দু’জন সমবয়সী মেয়ে লামিয়া ও মেঘলার জীবনে কি ভিন্ন পরিণতি! অথচ দু’জনই কি দারুণ সম্ভাবনাময় তরুণী! পার্থক্য ছিল শুধু তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থার, সমর্থনের, সাহসের। একজনের পরিবার ডানামেলা পাখির মতো স্বাধীনভাবে আকাশে উড়তে শিখিয়েছে। অন্যজনের (স্বামীর) পরিবার তার ডানা ভেঙ্গে ফেলে এসেছে মর্গে (১৫ ডিসেম্বর ২০২১)!

এমন মেয়েই আজকাল বেশি দেখা যায় যারা নিজ যোগ্যতায় বিদেশে পড়তে যায়। আই.এল.টি.এস-টোফেল স্কোর ও যোগ্যতার ভিত্তিতে এবং প্রচুর অর্থ খরচ করে আন্ডার গ্র্যাড করতে মেয়েরা একাই বিদেশে যায়। বিয়ে করে পাত্রস্থ হয়ে পড়তে আসা মেয়েদের শেষমেষ সংসারটাকেই ধরে রাখতে শিখতে হয়। “কিছু পেলে কিছু দিতে হয়” সেই হিসাবটা মেলাতে গিয়ে পুরো জীবনটাই উৎসর্গ করতে হয় মেয়েদেরকেই বেশি। কারণ বিদেশে দু’জন একসাথে পড়াশোনা করা কিংবা একজনের রোজগারে অন্যজনের পড়াশোনা করা দারুণ খরচের ব্যাপার, যদি না তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল কোনো পরিবারের সদস্য হন এবং প্রয়োজনীয় সমর্থন পান। অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল নয় এমন পরিবারের মেয়েকে দাবিয়ে রাখার মানসিকতা বাংলাদেশের বেশির ভাগ শ্বশুরবাড়ির।
সেই ক্ষেত্রে এরকম পরিবারের একটি মেয়ের প্রথম থেকেই পড়াশুনায় মনোনিবেশ করে সকল বাঁধা অতিক্রম করে জীবনে কিভাবে এগিয়ে যাবে সে দিকে নজর রাখতে হবে। অন্যের সাহায্য নিয়ে দাঁড়াতে গেলে সেক্ষেত্রে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার শিকার হতে হবে সেটা মনে রাখা খুব জরুরি।

একাধিক স্ত্রী বা নারী বন্ধু থাকলে একটি পুরুষকে হিরো মনে করা হয়; বলা হয়- ছেলেদের এমনটা হয়েই থাকে। আর পাশাপাশি একজন নারীর একের অধিকবার প্রেমে পরলে তাকে মনে করা হয় চরিত্রহীনা। মেঘলার খুনী স্বামীর একাধিক স্ত্রী ছিল- সন্তানও ছিল অথচ সেই স্বামী তার স্ত্রীকে সন্দেহ করতো, মেঘলাকে সে বিধিনিষেধের জালে আটকে রাখত! শিক্ষাক্ষেত্রের পুরুষ বন্ধুদের সাথে কথা বলা নিষেধ, চুল কেটে তার শরীরটাকে হিজাবের মধ্যে আড়াল করে দেয়া, মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া, ইউনিভার্সিটিতে গেলে ফেইসটাইমে শুধু নজরদারি করার জন্য মোবাইল ফোন রাখতে দেয়া, গায়ে হাত তোলা এভাবে প্রতিনিয়ত তার আত্মসম্মানে আঘাত করা। খুব অবাক লাগেনি যখন জেনেছি, তাকে কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসে নি! তার মাতৃস্থানীয় শাশুড়ীও না! সারারাত ধরে স্বামী আঘাতের পর আঘাত করে চললো, শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত। কেউ মনে করলো না যে, সে মানুষ! বাড়ির সবাই তাকে শুধু মেয়ে মানুষ মনে করলো!

দু/তিন কন্যার পরিবারে বড় মেয়ের সময়মতো বিয়ে হওয়া, মার খেয়ে হলেও সে বিয়ে টিকিয়ে রাখা, জীবন বিপন্ন হচ্ছে জেনে বুঝেও কাউকে না জানানো বা সাহায্য না চাওয়া এইসব ঘটনা সবসময়ই আমরা দেখছি অথচ পরিবর্তনের কথা ভাবি না। লোকে কি বলবে সেই ভাবনা ভেবে আমাদের জীবন চালিত হচ্ছে, এমনকি সে জীবন শেষও হয়ে যাচ্ছে- তবু পরিবর্তনের কথা ভাবছি না!

মা এবং শাশুড়ী দু’জনেরই ভূমিকা ছিল মেয়েটিকে মৃত্যুর মতো ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়ার জন্য। মেঘলার পরিবার মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে বিদেশে পাঠানোর কথা না ভেবে যদি তাকে একাই বিদেশে পাঠিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ করে দিতো তাহলে হয়তো আজ মেয়ের ভবিষ্যৎটা অন্যরকম হতো! মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে পরাধীন জীবনযাপন করছে জেনেও মেয়েকে ফিরিয়ে আনার কথা মা’দেরকে ভাবতে শেখায় না যে সমাজ, সে সমাজকে কি তোয়াক্কা করা উচিত? সমাজ কিন্তু রক্ষা করতে পারেনি তাদের সন্তানের জীবন, মেয়েটির জীবন!

যাই হোক। একজন নারীর একাধিক পুরুষসঙ্গী থাকা বা বদল করা অথবা খোলামেলা পোশাক পরার মধ্যেই কি শুধু স্বাধীনতা আছে? পছন্দমতো কাজ করা, চিন্তা করা এবং সে মোতাবেক জীবনযাপন করার মধ্যেই স্বাধীনতার স্বাদ থাকে।

গত বছরের শুরুর দিকে (৭ জানুয়ারি ২০২১) সংবাদে দেখেছি, আনুশকা নুর আমিন নামের একটি মেয়ে আঠারো না পেরোতেই প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে মৃত্যুবরণ করে। আমরা সামাজিক জীবেরা তার চরিত্রের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছি। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানোর জন্য মেয়ের বাবামাকে দোষারোপ করেছি। প্রতিটি টক-শো’তে বিজ্ঞজনেরা নানাভাবে বলতে চেয়েছেন মেয়ের মা কেন খোঁজ রাখেনি মেয়ে কোথায় যাচ্ছে? অথচ আমরা একটি বারও ভেবে দেখেছি কি, ১৭/১৮ বছর বয়সের একটি মেয়ে এই রকম পরিস্থিতিতে কিভাবে নিজেকে রক্ষা করতে হবে সেই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটি সে পেয়েছিল কি? বা না পেলে কেন পায়নি? কখন "না" বলতে হবে এবং শারীরিক সম্পর্কে জড়াবার আগের কোনোরকম শিক্ষা তার ছিল কিনা? কেন সে তার মাকে না জানিয়ে মিথ্যা বলে ছেলেটির সাথে দেখে করতে গেছে? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন আমাদের মনে আসা উচিত ছিল। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের জানা থাকা প্রয়োজন যাতে আমরা আমাদের মেয়েদের বাঁচাতে পারি।

আমাদের সমাজে বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক কি এতোটা বন্ধুত্বপূর্ণ যে, সন্তান তার বিপরীত লিঙ্গের কারো প্রতি আকর্ষণ, সম্পর্ক, যৌনতা বা শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে বাড়িতে খোলামেলা আলাপ করতে পারে? গর্ভনিরোধক বা জন্ম নিয়ন্ত্রণ অথবা অস্বাভাবিক উপায়ে শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে আগ্রহ তৈরি হলে সে বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করা তো বহু দূরের কথা! ঠিক সে কারণেই একটি ছেলের বাসায় দেখা করতে গেলে আনুশকাকে বলে যেতে হয়েছে সে নোট আনতে যাচ্ছে। মায়ের সাথে লুকোচুরিহীন সহজ সম্পর্ক থাকলে হয়তো ঘটনাটা ইতিবাচক হোতো। আনুশকা বেঁচে থাকতো পরিবারের মাঝে।

উন্নত বিশ্বের স্কুলগুলোকে শিক্ষার্থীর বয়সোপযোগী, বিজ্ঞানসম্মত ও সঠিক প্রমাণ-ভিত্তিক যৌনশিক্ষার (Sex education) কোর্স প্রদান করা হয় তবে অবশ্যই তা পিতামাতার সম্মতিতে। ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত দেয়া এই কোর্সে অবশ্যই গর্ভাবস্থা এবং যৌনরোগ প্রতিরোধের উপায় এবং তা থেকে কিভাবে বিরত থাকবে এবং গর্ভনিরোধের বিষয়ে নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত থাকে। এখানকার সমাজে, যৌনতা বা শারীরিক সম্পর্ক জীবনের একটি স্বাভাবিক অংশ; এটি যৌন শিক্ষা থাকলেও ঘটে বা সে শিক্ষা না নিলেও ঘটে। তাই অনেক বাবা মা-ই মনে করেন সন্তানের যৌন শিক্ষা থাকা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ইতিমধ্যে জানি যে, যৌনশিক্ষা কিশোর-কিশোরীদের যৌন মিলনে উৎসাহিত করে না, বরং নিরুৎসাহিত করে। যে সমস্ত ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে আনুষ্ঠানিক যৌনশিক্ষা পায় এমন ছাত্রদের তুলনায় যারা এই কোর্সে অংশ নেয়নি তাদেরকেই আগে শারীরিক সম্পর্কে জড়াতে দেখা যায়।

যে কোনো বিষয়ে সঠিক জ্ঞান প্রাপ্তির অধিকার প্রত্যেকের। পিতামাতার দৃষ্টিভঙ্গি বা চিন্তাভাবনার সীমাবদ্ধতার কারণে ছেলে-মেয়েদের এই রকম একটি সময়োপযোগী বিষয় সম্পর্কে না জানা বা নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থীর মধ্যে এই বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকাও উচিত নয়। সঠিক ও বিজ্ঞানসম্মত যৌনশিক্ষা পাওয়া মানবাধিকারও বটে।

ধরে নিলাম, একজন শিক্ষার্থীর শারীরিক সম্পর্কে সক্রিয় থাকার কোনো পরিকল্পনা নেই। তার মানে কিন্তু এই নয় যে সে যৌনতা, শরীরের অন্যান্য অঙ্গের মতো যৌনাঙ্গ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা (Anatomy), গর্ভনিরোধক এবং যৌনরোগ থেকে নিজেকে কিভাবে রক্ষা করবে এমন অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে শিখবে না। সেক্স এডুকেশন ক্যালকুলাসের মতোই গুরুত্বপূর্ণ, তাহলে কেন আমরা একটি শিখবো কিন্তু অন্যটি নয়? আমাদের দেশের সমাজে বাবা মায়েরা ছেলেমেয়েদেরকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াবেন, ইংলিশে কথা বলতে শেখাবেন, পাশ্চাত্যের মতো আচার ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে শিখাবেন কিন্তু তার একটা ম্যানুয়াল বা নীতিমালা তো থাকা চাই, তাই না? যদি খুব শিগগিরই আমরা সচেতন না হই আনুশকার বাবা- মায়ের মতো এমন অভাগা অনেক বাবা, মা-ই আমরা সংবাদে হয়তো দেখবো।

আমি আমার কথা বলতে পারি। আমি বাংলাদেশে জন্ম নেয়া ও বেড়ে ওঠা মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আছি প্রায় বাইশ বছর। আমি কিশোরী মেয়ের মা। আমার মেয়ের সাথে এইরকম সংবেদনশীল বিষয়ে আলাপ করার জন্য আমার পূর্ব প্রস্তুতি লাগে কারণ আমি সেভাবে বেড়ে উঠিনি যেখানে আমি আমার মায়ের সাথে সবরকম আলাপ করতে পারি। এখনো অনেক কথা মাকে বলা যায় না এমনটাই মনে করি। কিন্তু বর্তমানে আমি যে সমাজের বাসিন্দা সেখানে মেয়ের সাথে বন্ধুর মতো সম্পর্ক না থাকাটা বরং বেমানান এবং অস্বাভাবিক। কিছু বিষয় আমি যতই আড়াল করি না কেন বা তাকে আলাপ করার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করি না কেন, সে নিষিদ্ধ বিষয়গুলো সে জানবে বা ভুলভাবে জানবে বাইরের কোনো সূত্র থেকে। তাই মা হিসেবে, মেয়ে জানতে চায় সে রকম বিষয়ে অন্য মায়েদের মতো 'আপ টু ডেট' থাকাটা দরকার বলে মনে করি। শৈশবে মনের খুব গভীরে প্রোথিত আমার নিজস্ব বিশ্বাস এবং স্বভাব এখানকার অনেক ভাবনা ও কৃষ্টি থেকে আলাদা। তবুও চেষ্টা থাকে মেয়েকে যে কোনো বিষয়ে কথা বলার মতো একটা পরিবেশ বাড়িতে দেয়ার।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিশোর বয়সে গর্ভধারণের হার গত ২০ বছরে হ্রাস পেয়েছে। ২০১৮ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের মধ্যে শিশু জন্মদানের হার ছিল প্রতি ১,০০০ মহিলার মধ্যে ১৭.৪ জন। ২০১৯ সালে, তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৬.৯-এ (CDC)। ২০০৯ এ বাংলাদেশে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের মধ্যে প্রজনন হার ছিল প্রতি এক হাজারে ৯১.৯০ জন। বাংলাদেশে বয়ঃসন্ধিকালের জন্মহার ২০১৯ এ কমে তা হয়েছে প্রতি এক হাজার মহিলার মধ্যে ৮১.৬৬ জন (statista)। ব্যাপক পাঠ্যক্রম-ভিত্তিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যৌন শিক্ষার সঙ্গে মানসিক, শারীরিক এবং সামাজিক দিকগুলো সম্পর্কে শিক্ষাদান করা হয় বলেই কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক করার ক্ষেত্রে সম্মানজনক সামাজিক এবং যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলার মনোভাব ও মূল্যবোধ তৈরি হয়। প্রমাণ-ভিত্তিক যৌনস্বাস্থ্য শিক্ষা গ্রহণ করার কারণে একাডেমিক সাফল্য বাড়ে, ডেটিং সহিংসতা এবং বুলিং (Bullying) প্রতিরোধ হয়। তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক গড়ে ওঠে; অপরিকল্পিত শারীরিক সম্পর্ক বা গর্ভাবস্থা, এইচআইভি (HIV)এবং এসটিআই (STI) হ্রাস পায়। আর এই সেক্স এডুকেশনের কারণেই বয়ঃসন্ধিকালীন প্রজনন হার বর্তমানে কমে চলেছে, যদিও বাংলাদেশে এই সংখ্যা এখনো অনেক বড়। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগে, জোর করে (Forced marriage), অল্প বয়সে (child marriage) কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই বিয়ে দেয়ার কারণে বাংলাদেশে কিশোরী বয়সে শিশু জন্মের হার এতো বেশি। যদিও বাংলাদেশে স্কুলগুলোতে যৌনশিক্ষার ব্যবস্থা আছে, তবে অধিকাংশ শিক্ষকই রক্ষণশীল পদ্ধতিতে বিষয়টি পড়ান। এবং এই বিষয়ে পড়ানোর অভিজ্ঞতাহীন শিক্ষক বইয়ের যৌনতা সম্পর্কিত অধ্যায়গুলো এড়িয়ে যান বলেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই বিষয়ে সঠিক জ্ঞানের অভাব থেকে যায়।

বহুবিধ বাঁধা অতিক্রম করে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর ভারত বর্ষে বিধবাবিবাহকে আইনগতভাবে স্বীকৃত করান ১৮৫৬ সালে। অথচ বিধবাবিবাহ বা বহু বিবাহে আইনী কোনো বাঁধা না থাকলেও সমাজ আজও এই বিষয়টিকে সহজে গ্রহণ করে না। দেড়শ’ বছরের বেশি পেরিয়ে গেলেও নারীসমাজ একটি সম্পর্কে সফল না হলে তা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন করে জীবনকে ভাবতে প্রস্তুত নয়। বরং অসফল হলেও একটি তিক্ত সম্পর্কে আমৃত্যু থেকে যাবার পশ্চাৎগামী বাসনা নিয়ে বাঁচে।

জোরপূর্বক বিয়ে (Forced marriage) দেয়াও আমাদের দেশের কিছু জায়গায় এখনো দেখা যায়। ২০১৭ সালের বিতর্কিত মডেল আভ্রিলকে বিতর্কের শিকার হতে হয়েছিল কারণ তাকে তারই জন্মদাতা পিতা মাত্র ষোলো বছর বয়সে জোর করে বিয়ে দিয়েছিল বলে। মিস ওয়ার্ল্ডের মতো একটি আলোচিত অনুষ্ঠান এবং টিভি চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা প্রচারিত হয়েছে বলে আমরা জেনেছি আভ্রিলের ঘটনা। এরকম ঘটনা অগণিত মেয়ের জীবনে ঘটে-ঘটছে যা অজানাই রয়ে যায়-যাবে। কিছুদিন আগে আভ্রিলের মডেলিংয়ের ছবি দেখেছি আমারই এক বন্ধুর বিউটি স্পা’ এর ব্যবসায়িক পেইজে। মেয়েটি যেন সমাজকে দেখিয়ে দিয়েছে কাজ ও পরিশ্রম করে স্বসম্মানে বেঁচে থাকা যায়।

নিজ স্বামীর দ্বারা দুই চোখে আঘাত পেয়ে চিরঅন্ধ হয়েও রুমানা মঞ্জুর আজ আইনবিদ হয়েছেন। অন্ধদের জন্য লিখনাদির বিশেষ ব্রেইল পদ্ধতিতে আইন বিষয়ে পড়াশুনা করে ডিগ্রী অর্জন করেছেন কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ২০১১ তে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সেই ঘটনাকে পেছনে ফেলে মাত্র ছয় বছরের ব্যাবধানে ২০১৭ সালে রুমানা নিজেকে প্রমাণিত করেছেন সফল মা ও নারী হিসেবে। দুর্ঘটনা ঘটেই মানুষের জীবনে তাই বলে থামিয়ে দিতে নেই জীবনকে। রুমানার জীবন হয়তো আগের মতো স্বাভাবিক হয়নি তবে জীবনকে সহজভাবে নিয়েছেন তিনি। আমাদের ভাবনাগুলো হতে হবে অসীম যেখানে আকাশ হবে সীমানা।

মনে রাখতে হবে, জীবনে সুযোগ কেউ করে দেয় না তা তৈরি করে নিতে হয় যোগ্যতা দিয়ে, পরিশ্রম দিয়ে বাকিটা অবশ্যই ভাগ্য এবং উপরওয়ালার ইচ্ছে। আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজেকেই নিয়ে এগিয়ে থাকার কথা ভাবতে হবে, ঠিক যেমন করে ভাবতে শিখেছিল অঙ্কবিদ শকুন্তলা দেবী, রাজনীতিবিদ ইন্দিরা গান্ধী, মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন, কিংবা পেপসিকোর প্রধান কার্যনির্বাহক ইন্দ্রা কৃষ্ণমুর্থী নুই।

বিঃ দ্রঃ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত নারী বিষয়ক খবরের ভিত্তিতে এবং সেসব থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই লেখা।

[লেখক: মাষ্টার্স ইন পাবলিক হেল্থ, মিল্কেন ইন্সটিটিউট স্কুল অব পাবলিক হেল্থ,জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি। ওয়াশিংটন ডি সি]

সর্বাধিক পঠিত


ভিডিও