বাংলাদেশ

বছরে বেওয়ারিশ লাশ দাফন হাজারের বেশি

1126_download (5).jpg

পোশাক ও ছবি দেখে ছেলেকে শনাক্ত করার পর মা জানতে পারলেন ১১ দিন আগে বেওয়ারিশ হিসেবে লাশ দাফন করা হয়েছে। তার আগে প্রায় এক মাস বেওয়ারিশ হিসেবে মর্গে পড়েছিল ছেলের লাশ। গত বছরের ১৪ জানুয়ারি হাতিরঝিলের জলাশয় থেকে পুলিশ লাশটি উদ্ধার করেছিল। পরিচয় না পাওয়ায় এক মাস পর ১১ ফেব্রুয়ারি আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে লাশ দাফন করা হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি মনোয়ারা বেগম নামের এক নারী হাতিরঝিল থানায় এসে দাবি করেন, দাফন করা লাশটি তাঁর ছেলে সাদমান সাকিবের।

মনোয়ারা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলেকে রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। কিন্তু কবরটি শনাক্ত করা যায়নি। ওই দিন আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম চারটি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে। কোনটি আমার ছেলের, সেটি জানতে পারিনি।’

তিনি জানান, তাঁর ছেলে মালয়েশিয়ায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। করোনার সময়ে সে দেশে আসে। তাঁর ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। মনোয়ারা বেগমের এটুকুই সান্ত্বনা, ছেলের লাশ রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

হাতিরঝিল থানার ওসি আবদুর রশিদ গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, সাদমানের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছিল। এর দুই মাস পর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে শ্বাসরোধে হত্যার বিষয় এলে থানায় নিয়মিত মামলা হয়। মামলাটি তদন্ত করছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহাদত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এ মামলায় এখন পর্যন্ত কোনো ক্লু উদ্‌ঘাটন করা যায়নি।

আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বলছে, সাদমানের পরিচয় পাওয়া গেছে। তবে এমন ঘটনা খুব বেশি ঘটে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা লাশের পরিচয় শনাক্ত হয় না। এক যুগে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম ১৩ হাজার ৩২৪টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে। এই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ১ হাজার ১০০–এর বেশি লাশ দাফন করে সংস্থাটি।

আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের ট্রাস্টি এবং সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজিম বখশ প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক মানুষ নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে আমাদের কাছে আসে। কেউ কেউ হদিস পায়, কেউ পায় না। যাঁরা আসেন, সবার ছবি আমরা দেখাতে পারি না। পুলিশ লাশগুলো যখন দেয়, তখন ছবি দেওয়ার কথা। ছবি নিয়মিত পাওয়া যায় না। এগুলো তোলে পুলিশ। এ বিষয়ে আরও যত্নবান হওয়া উচিত।’

পুলিশ বলছে, অজ্ঞাতপরিচয় লাশ উদ্ধার হলে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। তারপর ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে লাশ পাঠানো হয়। লাশ দেখে হত্যার আলামত বোঝা গেলে হত্যা মামলা করে পুলিশ। অন্যথায় অপমৃত্যু মামলা করা হয়। লাশ সংরক্ষণের পর যখন বুঝতে পারে তার আর কোনো স্বজন পাওয়া যাবে না, তখন তারা লাশ আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, লাশ উদ্ধারের পর পরিচয় শনাক্ত করা না গেলে আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর তা আঞ্জুমান মুফিদুলকে দাফনের জন্য হস্তান্তর করা হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো সময়সীমা নেই। কারণ দীর্ঘ সময় ধরে লাশ সংরক্ষণ করার সুযোগ নেই।

১০০ বছরের বেশি সময় ধরে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বেওয়ারিশ লাশ দাফনের কাজটি করছে। বেওয়ারিশ লাশ সৎকারের জন্যই ১৯০৫ সালে সংস্থাটির গোড়াপত্তন করা হয়। এখন বেওয়ারিশ লাশ দাফনের পাশাপাশি শিক্ষা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত রয়েছে সংস্থাটি।

প্রযুক্তির এ যুগেও তারা বেওয়ারিশ
অজ্ঞাতনামা লাশের পরিচয় শনাক্তে বিশেষায়িত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তিন বছর ধরে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র সার্ভারের তথ্যভান্ডারে সংরক্ষিত আঙুলের ছাপ মিলিয়ে তাদের পরিচয় শনাক্ত করেন পিবিআই কর্মকর্তারা। তবু উদ্ধার হওয়া লাশের বড় অংশ বেওয়ারিশ হিসেবেই থেকে যাচ্ছে।

সংস্থাটি জানায়, ২০১৯ সালের শুরু থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে আড়াই হাজার লাশের পরিচয় শনাক্ত করে পিবিআই। এই সময়ে ১ হাজার ১০০ লাশের পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি সংস্থাটি। যেসব লাশের পরিচয় পাওয়া যায়, এর মধ্যে একটি বড় অংশ সড়ক এবং রেল দুর্ঘটনায় মারা যায়। আবার কেউ কেউ আছে ভবঘুরে বা ছিন্নমূল। একইভাবে আগুনে পুড়ে মৃত্যু হওয়া অজ্ঞাতনামা অনেকের পরিচয়ও মেলানো যায় না।

পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ফরেনসিক) মো. মোস্তফা কামাল রাশেদ প্রথম আলোকে বলেন, গলে যাওয়া, পচে যাওয়া লাশের আঙুলের ছাপ মেলানো যায় না। অনেক সময় দেখা যায় মৃত ব্যক্তির রক্তসঞ্চালন না থাকায় আঙুল কুঁচকে যায়। তখন আঙুলের ছাপ মেলানো যায় না। ২০১০ সালের আগে এনআইডি করেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও আঙুলের ছাপ মেলানো কঠিন। ভবঘুরে এবং ছিন্নমূল মানুষের এনআইডি না থাকায় তাদের লাশ শনাক্তেও সমস্যা তৈরি হয়।

তিন বছরে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা কমছে
এক যুগে গড়ে ১ হাজার ১০০–এর বেশি লাশ দাফন করলেও গত তিন বছরের হিসাব ধরলে গড়ে ৬১৫ জনের লাশ দাফন করেছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। তিন বছর ধরে এই সংখ্যা নিম্নমুখী। ২০১৯ সালে বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে ৭৯৫টি। পরবর্তী দুই বছরে এই সংখ্যা ৬৩৩ এবং ৪১৬।

এ বিষয়ে পিবিআইয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এনআইডি সার্ভারে সংরক্ষিত আঙুলের ছাপ মিলিয়ে লাশের পরিচয় শনাক্ত এবং মুঠোফোনের সূত্র ধরে অনেক লাশের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। এ কারণে হয়তো তিন বছরে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা কমছে।

পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ফরেনসিক) মো. মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, তিন বছর ধরে পিবিআই অনেক অজ্ঞাতপরিচয় লাশের পরিচয় শনাক্ত করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করতে সহায়তা করছে। এ কারণে বেওয়ারিশ লাশ দাফন কমে আসছে।

সর্বাধিক পঠিত


ভিডিও