সাহিত্য

রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে কিছু কথা

2768_image-548468-1651957407.jpg

১৯০৮ সাল। শান্তিনিকেতনে বর্ষা উৎসবের পর রবীন্দ্রনাথ শরৎকালকে আহ্বান করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে ক্ষিতিমোহন সেন লিখেছিলেন, ‘বর্ষা গেল, খুব ভালো করিয়া শারদোৎসব করিবার জন্য কবি উৎসুক হইলেন। আমাদিগকে বলিলেন, বেদ হইতে ভালো শারদ শোভার বর্ণনা খুঁজিয়া বাহির করিতে।’ এরপর ক্ষিতিমোহন সংস্কৃত সাহিত্যের নানা স্থানে খোঁজ করলেন। এদিকে কবিও লেগে গেলেন শরৎকালের উপযুক্ত সব গান রচনা করতে। একে একে সেবার অনেক গান রচনা করা হলো। সেই সময় কবির মনে হয়েছিল, গানগুলোকে একটা নাট্যসূত্রে বাঁধতে পারলে ভালো হয়। এরপরই তৈরি হয়েছিল ‘শারদোৎসব নাটক।’ ক্ষিতিমোহন সেনের কাছ থেকেই জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ১৩১৫ বঙ্গাব্দের ৩ ভাদ্র তারিখে দুটো গান বেঁধেছিলেন, যার একটি ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া।’ বিশ্বভারতী পত্রিকার ১৩৫০ সালের বৈশাখ সংখ্যায় ‘বেদমন্ত্রবসিক রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে ক্ষিতিমোহন সেন এ কাহিনির কথা লিখেছিলেন।

শিরোনামেই উল্লেখ করা হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সম্পর্ক আছে। যেমন ‘অলি বার বার ফিরে যায়’ বিখ্যাত গানটির কথাই ধরা যাক।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাতাশ বছর বয়সে নিজের লেখা একটি গান গেয়ে ইংল্যান্ডে পরিচিত মহলে গায়ক হিসাবে খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। ১৮৯০ সালে লন্ডন থেকে ‘য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি’তে এ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, “রাত্তিরে অনেকগুলো বাংলা গান গাইলুম। ‘অলি বারবার’টা Miss M-এর ভয়ানক ভালো লেগেছে : ‘It is so sweetly pretty, so quaintly beautiful and it sounds so pathetic with his minor tones’।’ পরের দিন সেই ডায়েরির খসড়াতেই আবার লিখলেন, গরংং গ-আবার ‘অলি বারবার’টা গাওয়ালে। সেটা তার অত্যন্ত ভালো লেগেছে।’ পরের শুক্রবার কবি সন্ধ্যাবেলা একটা নিমন্ত্রণে গিয়েছিলেন। সেদিন মিস এম কবিকে বলেছিলেন, যদি এইরকম কতকগুলো দিশি গান তাকে শোনানো যায়, তাহলে তিনি একটি ওরিয়েন্টাল অপেরা লিখতে পারেন। আসলে তিনি কবির কম্পোজিশন শুনে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। কারণ কবি গানের গ্রামার না জেনে এমন কম্পোজ করলেন কী করে?

গুরু নানক রচিত গানের ভাষান্তর ‘গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে’ অনুবাদ গানটি রবীন্দ্রনাথের প্রথম লেখা গান। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১২৮১ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন সংখ্যা ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায়।

তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, রবীন্দ্রনাথের গাওয়া প্রথম গান কোনটি? ছোটবেলা থেকেই গানের চর্চা করলেও গবেষকদের মতে, রবীন্দ্রনাথের গাওয়া প্রথম গান হলো খুড়তুতো দাদা গণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘দেখিলে তোমার সেই অতুল প্রেম আননে’ গানটি। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন সাত। তার আরও পরে ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়।

রেকর্ডে প্রথম ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল কনক দাশের গাওয়া ১৯৩৫-এ প্রকাশিত রেকর্ডে। এর আগে লেখা হতো ‘রবীন্দ্রগীতি’ কখনো ‘কথা ও সুর রবীন্দ্রনাথ’ কিংবা শুধু বন্ধনীর মধ্যে ‘রবীন্দ্রনাথ’ অথবা ‘আধুনিক’।

রবীন্দ্রনাথের প্রথম গানের সংগ্রহ পুস্তকটির নাম-রবিচ্ছায়া, প্রকাশিত হয় ১৮৮৫ সালে। ‘গীতবিতান’ ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয়। ঠাকুর পরিবারের সদস্যদের ছাড়া রবীন্দ্রনাথের গান তার কাছ থেকে শিখে বাইরে গাইতে এবং পরবর্তীকালে রেকর্ড করেন অমল দাশ। তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বোন। রেকর্ডে নাম থাকত মিস দাশ, অ্যামেচার।

রবীন্দ্রসংগীতের প্রথম যুগে বিখ্যাত সংগীতশিল্পীরা তাদের নিজের সুরে অথবা রবীন্দ্রনাথের সুরে কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন গায়কীতে রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করতেন। বিশ্বকবি ১৮৮৬ সালে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশন উপলক্ষ্যে ‘আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে’ গানটি রচনা করেন।

১৮৮৭ সালে রবীন্দ্রনাথের একটি ব্রহ্মসংগীত শুনে মুগ্ধ হয়ে তার পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পুত্র রবীন্দ্রনাথকে ৫০০ টাকার চেক দেন। গানটি ছিল-‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে’। আমরা জানি, বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের জাতীয় সংগীত রবীন্দ্রনাথের লেখা।

১৯০৫ সালে ইংরেজ সরকার যখন বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব দেয়, তখন তার প্রতিবাদে ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’-গানটি কবি রচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের একটি গান স্বামী বিবেকানন্দের অত্যন্ত প্রিয় ছিল। শান্তিদেব ঘোষ এ গানটি সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন-‘এই বোধহয় তার প্রথম রচিত ধর্ম সংগীত’। কোন গান সেটা? ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা/এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান নিয়ে আজ কম গবেষণা হচ্ছে না।

Drink to me only এবং Auld Lang Syne এ দুটি বিদেশি গান ভেঙে রবীন্দ্রনাথ দুটি গান তৈরি করেন। গান দুটি কী কী? Drink to me only অবলম্বনে ‘কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া/তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া।’ এবং Auld Lang Syne অবলম্বনে ‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়/ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।’ স্যার তারকনাথ পালিতের বাড়িতে কংগ্রেস নেতাদের নিমন্ত্রণে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে উদাসীন যারা তাদের ভর্ৎসনা করে কবি একটি গান করেন। গানটি ছিল-‘আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না।’

‘ভারতীয় সংগীত সমাজে’ ১৯০৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুকে সংবর্ধনা জানাতে একটি সম্মেলনের আয়োজন করেন। এই সভা উপলক্ষ্যে রচিত রবীন্দ্রসংগীতটি ছিল-‘জয় তব হোক জয়/স্বদেশের গলে দাও তুমি তুলে যশোমালা অক্ষয়।’ কবির স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর রচিত গানটি ছিল-‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।

‘তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে’-রবীন্দ্রনাথ এই গানটি রচনা করেন।

একটি জনপ্রিয় গান ছিল ‘বিশ্ববিদ্যাতীর্থপ্রাঙ্গণ কর’ মহোজ্জ্বল আজ হে। বরপুত্রসংঘ বিরাজ’ হে। গানটি রবীন্দ্রনাথ কোন সময় লিখেছিলেন?

১৯৪০ সালের আগস্ট মাসে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা শান্তিনিকেতনে এসে রবীন্দ্রনাথকে ডক্টর উপাধি প্রদান করেন। সেই উপলক্ষ্যে লেখা এই গান। অন্য গানের সুরে রবীন্দ্রনাখ ঠাকুর বেশ ক’টি গান রচনা করেছিলেন। যেমন-‘হরিনাম দিয়ে জগৎ মাতলে’... গানটির সুরে জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীতটি হলো-

‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে। একলা চলো, একলা চলো একলা চলো রে ... ।’

রবীন্দ্রনাথের পঞ্চষষ্ঠিতম জন্মদিনে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে পাঁচটি গাছ লাগান। এ বৃক্ষরোপণ উৎসব উপলক্ষ্যে লেখা গানটি আজও বৃক্ষরোপণের অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়। গানটি হচ্ছে- ‘মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে হে প্রবল প্রাণ।

ধূলিরে ধন্য করো করুণার পুণ্যে হে কোমল প্রাণ॥’

১৯২৯ সালে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি হিসাবে বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ দাসকে লাহোর জেলে পাঠানো হয়। এখানে রাজবন্দিদের ওপর ইংরেজরা যে অবর্ণনীয় দুর্ব্যবহার করত তার বিরুদ্ধে অনশন শুরু করেন তিনি। এ সময় তাকে জোর করে বহুবার খাওয়ানোর চেষ্টা করা হয়। তার অনশনের সংবাদে রবীন্দ্রনাথ খুব চিন্তিত ছিলেন। ৬৩ দিন অনশনের পর যতীন্দ্রনাথ দাস মৃত্যুবরণ করেন। তার এ মৃত্যু কবিকে অত্যন্ত ব্যথিত করে। বিষাদে ভরা মন নিয়ে কবি রচনা করেন- ‘সর্ব খর্বতারে দহে তব ক্রোধদাহ-/হে ভৈরব, শক্তি দাও, ভক্ত-পানে চাহো।’ শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের জুজুৎসু শেখানোর জন্য জাপান থেকে আনা হয় টাকাগাকিকে। এ কৌশল শিখতে ছেলেরা খুব আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এলেও মেয়েরা সংকোচবশত ততটা আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন না। কবি তাদের সংকোচ দূর করতে গানটি রচনা করেন।

‘সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান/সংকটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ’-। ১৩২৯-এ প্রচণ্ড গরমে শান্তিনিকেতনে ব্যাপক জলকষ্ট দেখা দেয়। অধ্যাপক ও ছাত্রদের মিলিত শ্রমে একটি নলকূপ বসানো হয়। এই উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ যে গানটি লেখেন সেটা হলো- ‘এসো এসো হে তৃষ্ণার জল, কলকল ছলছল/

ভেদ করো কঠিনের ক্রুর বক্ষতল কলকল ছলছল’...

Go there glory waits thee গানের সুরে রচিত রবীন্দ্রসংগীত হলো-

‘আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে

এত বাঁশী বাজে, এত পাখি গায়।

সখীর হৃদয় কুসুমকোমল-

কার অনাদরে আজি ঝরে যায়।’

২৪ জানুয়ারি ১৯৫০ সাল থেকে ‘জনগণমন অধিনায়ক’ গানটি ভারতের জাতীয় সংগীত হিসাবে স্বীকৃত হয়।

বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় সংগীতের স্টাফ নোটেশন বঙ্গবন্ধুর সরকার আমলে বিশেষ ব্যবস্থায় ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন (BBC) থেকে করিয়ে আনার ব্যবস্থা হয়েছিল। বাংলাদেশের বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ ও সুরকার সমর দাসকে পাঠানো হয়েছিল। সেখান থেকে স্টাফ নোটেশন নিয়ে আসার পর প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী কলিম শরাফী, আবদুল আহাদ এবং সন্জীদা খাতুন সমন্বয়ে গঠিত কমিটির দ্বারা সেটি অনুমোদন করানো হয়েছিল। জাতীয় অনুষ্ঠানে সংগীতের কতটা বাজানো হবে তা-ও নির্ধারণ করা হয়।

পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ এবং আওয়ামী লীগ নেতারা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালেই রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে আমাদের জাতীয় সংগীত হিসাবে নির্বাচনের পক্ষে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধকালে এবং পরবর্তীকালে জাতীয় সংগীতরূপে এ গানটি পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পায়। কিন্তু যেহেতু গানটি অনেক দীর্ঘ এবং জাতীয় সংগীতরূপে এটি গাওয়া এবং বাজানো অত্যন্ত কঠিন, সে কারণে বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ১৩-০১-১৯৭২ তারিখের মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়-

‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...’। এর প্রথম দশ লাইনকেই জাতীয় সংগীতরূপে গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া সিদ্ধান্ত হয় যে, রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতার ক্ষেত্রে বাদ্যযন্ত্রে এর প্রথম চার লাইন বাজানো হবে।

সুভাষ সিংহ রায় : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

যুগান্তর

সর্বাধিক পঠিত


ভিডিও