ইসলাম

সাংবাদিকদের ‘শায়েস্তা’ করতে আর কত আইন

3412_download (10).jpg

বাংলাদেশের সাংবাদিকদের মাথার ওপর আরেকটি খড়্গ ঝুলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে নতুন আইন করা হচ্ছে, নাকি প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধনের নামে এমন সব ব্যবস্থা করা হচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণের নতুন উপায়ে পরিণত হবে? এ প্রশ্ন উঠছে এই কারণে যে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নতুন আইন হচ্ছে বলার এক দিন না পেরোতেই তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘নতুন আইন হচ্ছে না।’ তবে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, প্রেস কাউন্সিল আইনের সংশোধন করার বিষয় সরকারের বিবেচনায় আছে। (সমকাল, ১৫ জুন ২০২২)

নতুন আইনের কথা শোনা যায় গত মঙ্গলবার রাজশাহীতে সাংবাদিকদের জন্য আয়োজিত কর্মশালায় বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের বক্তব্যে। তিনি বলেন, সাংবাদিকেরা অন্যায় করলে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রেখে একটি আইন হচ্ছে। আইনের খসড়া এখন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আছে। সংসদের আগামী অধিবেশনেই তা পাস হতে পারে। তিনি অবশ্য এ ধরনের নমনীয় শাস্তিতে সন্তুষ্ট নন। তাঁর কথা অনুযায়ী, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে এক দিনের জেলের পক্ষপাতী। জেলে গেলে তাঁর মনে হবে যে আমার কাজটা অন্যায় হয়েছিল। আর করা যাবে না।’ (প্রথম আলো, ১৪ জুন ২০২২)

বাংলাদেশে সাধারণভাবে মতপ্রকাশের ওপর, বিশেষ করে সাংবাদিকদের ওপর নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনের অভাব আছে বলে মনে করার কারণ নেই। প্রচলিত ফৌজদারি আইনের কথা বাদই দিলাম, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০১৮ কী ভয়াবহ অবস্থার সূচনা করেছে, তা জানেন না—এমন কেউ নেই। সাংবাদিকেরা হরহামেশাই অভিযুক্ত হচ্ছেন, আটক হচ্ছেন। অবস্থা বোঝার জন্য আরেকটি তথ্যের দিকে নজর দেওয়া যায়। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা এক বছরে এক ধাক্কায় ১০ ধাপ নেমেছে—১৫২ থেকে ১৬২, স্কোর নেমে হয়েছে ৫০ দশমিক ২৯ থেকে ৩৬ দশমিক ৬৩।

বিচারপতি নিজামুল হক যখন এ ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার পক্ষে সাফাই গাইছিলেন, তখন আর্টিকেল নাইনটিন নামের আন্তর্জাতিক সংগঠনসূত্রে জানা গিয়েছিল, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে বাংলাদেশে অন্তত ১১৮ জন সাংবাদিক হামলার শিকার হয়েছেন। (প্রথম আলো, ১২ জুন ২০২২)

এসব বিষয়ে বিচারপতি নিজামুল হক নিশ্চয় খবর রাখেন, কিন্তু সে বিষয়ে তাঁর উদ্বেগ নেই। উদ্বেগ হচ্ছে ‘আদার ব্যাপারী’ সাংবাদিক হয়ে উঠলেন কি না, সে বিষয়ে। আদার ব্যাপারী কথার কথা নয়; তিনি বলেছেন, ‘আদার ব্যাপারীদের জন্য তো সাংবাদিকতা নয়।’ আক্ষরিক অর্থেও যদি বিচার করি, তাহলে প্রশ্ন তো আসেই, আসলে ঠিক কোন ব্যবসা করলে সাংবাদিক হওয়া যাবে বলে প্রেস কমিশন মনে করে, এ রকম কোনো তালিকা করা হয়েছে কি না।

বিচারপতি নিজামুল হক এবং তাঁর কমিশন দায়িত্ব নিয়েছে, কারা প্রকৃত সাংবাদিক, সেটা নির্ধারণ করার। তিনি বলেছেন, ‘প্রকৃত সাংবাদিকদের জন্যই সাংবাদিকতা। এটাই এখন নিশ্চিত করার লক্ষ্য।’ প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের যে আইন, সেখানে কোথায় লেখা আছে, প্রেস কাউন্সিল আসল সাংবাদিক অনুসন্ধানের কাজের সেপাই সাজবে? প্রেস কাউন্সিলের কাজ কী, সেটা এমনকি সংস্থার ওয়েবসাইটেই লেখা আছে, ‘সাংবাদিকতার স্বাধীনতা বহাল এবং রক্ষা করা’ (প্রিজার্ভিং অ্যান্ড প্রোটেক্টিং দ্য ফ্রিডম অব দ্য প্রেস)। সেই সংস্থার প্রধান কী করে সাংবাদিকদের শায়েস্তা করতে হয়, এর জন্য প্রাণপাত করছেন। বাংলাদেশে এসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তাঁরা সম্ভবত জানেন না ওই প্রতিষ্ঠানের কাজ কী, তাঁদের কাজ কী; তাঁরা শুধু জানেন যে ক্ষমতাসীনদের তল্পিবাহক হওয়াই তাঁদের কাজ। একই অবস্থা মানবাধিকার কমিশনের।

এই যে আইন তৈরি করা হয়েছে বলে প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বলেছেন, সেটা কি সাংবাদিকেরা জানতেন? সাংবাদিকদের একাধিক ইউনিয়ন আছে, দলের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া এসব ইউনিয়নের একাংশ ক্ষমতাসীনদের পক্ষের লোকজন। তাঁরা কি জানতেন যে এ রকম আইন লেখা হচ্ছে? সংসদে পাস হওয়া তো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা হয়েছে—এমন স্মরণ করতে পারি না। এখন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদের বক্তব্যের পর এ নিয়ে আরও সংশয়ের সূচনা হলো এই কারণে, এ ধরনের আইন যদি বিবেচনায় না–ই থাকে, তাহলে প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান কিসের ভিত্তিতে বললেন, আইনের খসড়া তৈরি হয়েছে? তথ্যমন্ত্রীর কথায় সাংবাদিকেরা কতটা স্বস্তি পেতে পারেন?

যেসব আইন আছে এবং আইনের বাইরেও যা ঘটছে, তাতে সরকার সন্তুষ্ট নয়; আরও নতুন আইন চাই বলেই মনে হচ্ছে। নতুন আইন হোক কিংবা প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধন করেই হোক—নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা কেবল সেটাই হবে, তা নয়। ইতিমধ্যে উপাত্ত সুরক্ষা আইন, বিটিআরসির প্রবিধান এবং ওটিটি নীতিমালা তৈরি হচ্ছে। এগুলোর লক্ষ্য একটাই—নাগরিকের কথা বলার জায়গা একবারে বন্ধ করে দেওয়া।

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের তৈরি উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২২ (ডেটা প্রোটেকশন অ্যাক্ট); বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তৈরি ‘রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফর্ম’ এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান ও পরিচালনা নীতিমালা, ২০২১-এ এমন সব বিধান আছে, যেগুলোর না আছে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা, না আছে সীমা-পরিসীমা। (বিস্তারিত দেখুন, প্রথম আলো, ৯ মে ২০২২)

এসব আইন, প্রবিধান ও নীতিমালা একটি আরেকটি থেকে আলাদা নয়। এগুলো ভিন্ন ভিন্ন সময়ে জানা যাচ্ছে বা ভিন্ন ভিন্ন যুক্তি দিয়ে এগুলোর যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা হচ্ছে বলে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশে ক্রমাগতভাবে কথা বলার, ভিন্নমত প্রকাশের জায়গা যে নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে, তারই প্রমাণ। ক্ষমতাসীন দল এগুলোর মাধ্যমেই এমন এক অবস্থার তৈরি করছে, যেখানে একসময় আইনভঙ্গের জন্য কারও বিচারেরও দরকার হবে না। মানুষ এতটাই ভীত হয়ে পড়বে যে কথা বলার ঝুঁকিই নেবে না। আর তাঁরাই কথা বলবেন, যাঁরা জানেন, এ কথাই ক্ষমতাসীনেরা শুনতে চান।

এ ধরনের আশঙ্কা কল্পনাপ্রসূত নয়; একসময় পৃথিবীতে এ ধরনের দেশের সংখ্যা কম ছিল না। এখনো এ ধরনের দেশ আছে। বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের পশ্চাৎ-যাত্রার ফলে এ ধরনের দেশ তৈরি হচ্ছে, যেখানে গণমাধ্যমের সংখ্যা কম নয়, কিন্তু সাংবাদিকের স্বাধীনতা নেই, নাগরিকের কথা বলার অধিকার তিরোহিত, আইন করেই সেগুলো করা হয়েছে। ফলে এসব প্রস্তাবিত আইনের আসল উদ্দেশ্য সবার সামনে তুলে ধরা জরুরি। এগুলোর ভয়াবহতার বিষয়ে আলোচনার বিকল্প নেই। এ দায়িত্ব প্রাথমিকভাবে সাংবাদিকদের, গণমাধ্যমের; কিন্তু এ দায়িত্ব কেবল তাদের নয়—আমার, আপনার। এ খড়্গগুলো কেবল সাংবাদিকদের জন্যই তৈরি হচ্ছে না; নাগরিকদের কেউই তা থেকে বাঁচতে পারবে না।

● আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট
প্রথম আলো

সর্বাধিক পঠিত


ভিডিও