ইসলাম

কেমন হলো কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন

3443_download (14).jpg

সদ্য সমাপ্ত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন শুরু থেকেই ব্যাপক আলোচনায় ছিল। প্রশ্ন ছিল, এই নির্বাচন বর্তমান আউয়াল কমিশনের জন্য বড় ধরনের পরীক্ষা কি না অথবা মানুষের আস্থা ফেরানোর বড় পদক্ষেপ কি না। বেশির ভাগ পত্রপত্রিকা এই নির্বাচনকে নতুন নির্বাচন কমিশনের অগ্নিপরীক্ষা হিসেবে দেখেছে। এখন এই পরীক্ষায় কেমন করল এই কমিশন? আরও প্রশ্ন, ইভিএম নিয়ে যে শঙ্কা ছিল, সেটি কেটেছে কি না। এই লেখায় এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা ও নির্বাচনটি কেমন হলো, তা বিশ্লেষণের চেষ্টা করব।

অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর ফলাফল ঘোষণার একপর্যায়ে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। পত্রপত্রিকার মতে, ৪৫ মিনিট সময়ক্ষেপণ হওয়ার কারণে এবং দুবারের মেয়র মনিরুল হকের ১০৫টি কেন্দ্রে মাত্র ৩৪৩ ভোটে হেরে যাওয়ায় নির্বাচনটি নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। হওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ, তিনি সরকারি দলের প্রার্থী আরফানুল হকের কাছে পরাজিত হয়েছেন। মনিরুল ২০১০ সালে নিজের দল বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে আসছেন।

যদিও প্রথম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় মার্কায় বা প্রার্থিতায় নির্বাচন হয়নি, তবে বড় দুই দলের সমর্থন ছিল। ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৫ জানুয়ারি ২০১২ সালে তৎকালীন শামসুল হুদা কমিশনের বিদায়ের প্রাক্কালে। প্রথমবারের মতো ওই সময়কার ইভিএমে সম্পূর্ণ ভোট সম্পন্ন হয়েছিল এবং মনিরুল হক বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন। এরপর দ্বিতীয় নির্বাচনটি হয় নূরুল হুদা কমিশনের প্রথম দিকে, ২০১৭ সালে। তখনো বলা হয়েছিল, ওই নির্বাচন নূরুল হুদা কমিশনের অগ্নিপরীক্ষা। ওই নির্বাচনও সুষ্ঠু এবং কোনো বড় ধরনের গোলযোগ বা বিশৃঙ্খলা ছাড়া সম্পন্ন হয়েছিল এবং সদ্য বিদায়ী মেয়র মনিরুল স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই সময় ভোটার সংখ্যা ছিল প্রায় ২ লাখ, ভোটকেন্দ্র ছিল ১০৩টি। ভোট গ্রহণ হয়েছিল ব্যালট পেপারের মাধ্যমে। কোনো ধরনের কারচুপি অথবা আপত্তি ছাড়া এবং অত্যন্ত সুষ্ঠু হয়েছিল নূরুল হুদা কমিশনের অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচন। কথিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও, পরবর্তী সময়ে আর কোনো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছে কি না, তা ভেবে দেখার বিষয়। কাজেই মলাট দেখে বই বিবেচনা করা যায় না। নূরুল হুদা কমিশনের ব্যবস্থাপনায় কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের দ্বিতীয় নির্বাচনই যথেষ্ট প্রমাণ বহন করে। কাজেই কুমিল্লা নির্বাচন দিয়ে বর্তমান কমিশনের দক্ষতা পরিমাপ করা যৌক্তিক নয়।

এখন আসছি সদ্য সমাপ্ত কুমিল্লা নির্বাচন নিয়ে কিছু আলোচনায়। সাধারণভাবে নির্বাচনের তিনটি ধাপ রয়েছে এবং নির্বাচন বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই তিন ধাপকেই বিবেচনায় নিতে হয়। এক. ভোট-পূর্ব সময়, দুই. ভোট গ্রহণ চলাকালে এবং তিন. ভোট-উত্তর সময়। কুমিল্লা নির্বাচনে ভোট গ্রহণ-পূর্ব সময়, প্রচারণাকালে ভোট গ্রহণের সময় নির্বাচন কমিশন যে ব্যবস্থাপনাকে বিন্যাস করেছিল, তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত ছিল বলে মনে হলেও, নির্বাচন কমিশন পূর্বতন নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার বাইরে গিয়ে প্রচুর সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরাতেই প্রচুর খরচ করা হয়েছে। যদিও ব্যবস্থাপনার অর্থ ব্যয়ের অঙ্ক এখনো পরিষ্কার নয়, তবে কিছুদিনের মধ্যেই তথ্য পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। কমিশনকে চিন্তা করতে হবে সামনের নির্বাচনগুলোতে কত খরচ করতে হবে। প্রতিটি অঞ্চলের নির্বাচনী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে পরিকল্পনা করা সহায়ক হবে।

যেমনটা বলেছিলাম, আলোচিত তিনটি নির্বাচনের মধ্যে নির্বাচনে ওই সময়ে ৫৫টি কেন্দ্র ছিল। যেখানে ওই সময়কার সহজ ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছিল। বিএনপির প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখেই ব্যবহৃত হয়েছিল। ওই ইভিএমে বায়োমেট্রিক সংযোজিত না থাকায় সাধারণ মানুষকে বেগ পেতে হয়নি, যা এবার পেতে হয়েছে। যার অন্যতম কারণ বোধ হয় তিনটি নির্বাচনের মধ্যে ভোট গ্রহণের হার এবারই সবচেয়ে কম ৫৯ শতাংশের কাছাকাছি। পত্রপত্রিকার খবরে প্রকাশ যে লম্বা সময় লাগার কারণে বহু ভোটার ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। ভোট দিতে গিয়ে এক ঘণ্টার বেশি দাঁড়িয়ে থাকার অভিযোগও পাওয়া গেছে কোনো কোনো কেন্দ্রে। এসব কারণে, বিশেষ করে বয়স্ক ভোটাররা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে অনেকের বক্তব্যে এমনই মনে হয়েছে। ইভিএম ব্যবহারের অন্যতম যুক্তি ছিল দ্রুত ভোট গ্রহণ। বায়োমেট্রিকের কারণে দেরি হবেই। এরপরও সবকিছু মিলিয়ে ভোট গ্রহণ অত্যন্ত সুষ্ঠু হয়েছে, সন্দেহ নেই।

ভোট-পূর্ববর্তী সময়ে নির্বাচন কমিশন নিয়ে বহুল চর্চা হয়েছিল স্থানীয় সংসদ সদস্যকে স্থানত্যাগের চিঠি দেওয়া নিয়ে। একজন আইনপ্রণেতা হয়ে যিনি বিদ্যমান বিধির তোয়াক্কা না করে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তাঁর সমর্থনে দলের অনেকে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার নিয়ে কথা তুলে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন, যা এর আগে কখনোই হয়নি। নির্বাচন কমিশন বিদ্যমান আচরণবিধির ধারা (১৪)(ক) অনুযায়ী চিঠি দিয়েছে বলেই প্রতীয়মান এবং এর ব্যত্যয় হলে শাস্তির বিধানও রয়েছে। অবশ্য আলোচিত সংসদ সদস্য দলের প্রার্থীর প্রধান এজেন্ট হিসেবে নিয়োজিত হয়েছিলেন কি না, পরিষ্কার নয়। যদি নির্বাচন কমিশনের হাতে বিধির ধারা না-ও থাকত, তবে সংবিধানের ১১৯ ধারা অনুযায়ী চিঠি এবং সিদ্ধান্তই যথেষ্ট। উপমহাদেশে এ ধরনের ভূরি ভূরি, এমনকি বাংলাদেশেও উদাহরণ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে হাবিবুল আউয়াল কমিশন বেশ কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিল বলে মনে করার কারণ রয়েছে। এখানে কে হারলেন বা কার ইজ্জতহানি হয়েছে, এটা বড় কথা নয়; বড় কথা, ভবিষ্যতে কমিশন এ ধরনের পরিস্থিতি কীভাবে সামলাবে।

উল্লেখিত কারণে আলোচিত সম্মানিত সংসদ সদস্য উচ্চতর আদালতে গেছেন বলে সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন। তবে আমরা জানতে পারিনি, সেখানে সংবিধানের ধারা ১২৬ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন শুনানিতে পক্ষ ছিল কি না। না থাকলে সে বিষয়েও নির্বাচন কমিশনকে আরও তৎপর ও যত্নবান হতে হবে।

নির্বাচনের দ্বিতীয় পর্ব ভোট গ্রহণ অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হলেও গোল বাধে গণনার সময়, বিশেষ করে সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে গোলযোগের কারণে রিটার্নিং কর্মকর্তা হঠাৎ করে ফল ঘোষণায় সাময়িক বিরতি টানার পর। তখন ১০১টি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা করা হয়ে গিয়েছিল এবং ওই পর্যন্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক প্রায় ৬০০ ভোটে এগিয়ে ছিলেন। যখন কথিত গোলযোগের কারণে রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণায় সাময়িক বিরতি টানেন, মূল দুই প্রার্থী আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে সেভাবে ‘হাড্ডাহাড্ডি’ লড়াই হচ্ছিল। এমন একটি পরিস্থিতিতে রিটার্নিং কর্মকর্তার আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল। নির্বাচন কমিশনের এই কর্মকর্তা যথেষ্ট অভিজ্ঞ এবং নীতিমান হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে বিবেচিত। জুনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে আমার এই মূল্যায়ন। তাঁর কাছ থেকে অহেতুক সাময়িক বিরতি টানা প্রত্যাশিত ছিল না। তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার সাহায্য নিতে পারতেন। কোনো কারণেই বিলম্ব করা ঠিক হয়নি, যখন ফলাফলের এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। এখানেই জনমনে সন্দেহের অবকাশ তৈরি হয়েছে, যা নির্বাচন কমিশনের এত ভালো উদ্যোগে আরেকটি ক্ষত তৈরি হয়েছে। আশা করব, নির্বাচন কমিশন ভোটকেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল প্রকাশ করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করবে।

কুমিল্লার এ নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং তিনি আইনের আশ্রয় নেওয়ার কথা বলেছেন। আইনের আশ্রয় নিলে কারিগরিভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে বলা যাবে না, রায় না হওয়া পর্যন্ত। তবে মামলার জন্য গেজেট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এখানে প্রশ্ন থাকে, ফলাফলে কারচুপি হয়েছে, এটা প্রমাণ করতে হলে পুনর্গণনা করতে হবে, যা ইভিএম পদ্ধতিতে লিখিত রেজাল্ট জালিয়াতি ছাড়া প্রমাণ করা যাবে না। কারণ, ‘অডিট ট্রেইল’ নেই। এটাই এই ইভিএমের সবচেয়ে বড় খুঁত। ‘অডিট ট্রেইল’ ছাড়া ইভিএম নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। এখানে যদি নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন পরিচালনা আইন (সিটি করপোরেশন) ধারা ২০(খ) অনুযায়ী প্রত্যেক প্রার্থীর কাছে কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলের ফরম ধারা ২০(গ) মোতাবেক দিয়ে থাকে, তবে প্রার্থী সহজেই কথিত জালিয়াতি হয়েছে কি না, নিশ্চিত হতে পারবেন; অন্যথায় শুধু ইভিএম হয়তো সে সম্ভাবনা সংকুচিত করবে। তবে ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলোতে ইভিএমের ব্যবহার বিতর্কিত থাকবে ‘পেপার অডিট ট্রেইল’ না সংযোজন করলে।

যাহোক, ওপরের সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনার উপসংহারে বলতে হয় যে একটি ভালোভাবে অনুষ্ঠিত নির্বাচন দু-একটি ভুলের(?) কারণে প্রশ্নবিদ্ধ যাতে না হয়, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে আরও যত্নবান হতে হবে। কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব ও আসল পরীক্ষা সামনে রয়ে গেছে। আশা করি তারা সেদিকে আরও মনোযোগ দেবে।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)

hhintlbd@yahoo.com

প্রথম আলো

সর্বাধিক পঠিত


ভিডিও