ইসলাম

যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র নতুন শীতল যুদ্ধে হারতে পারে

3463_download (14).jpg

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, চীন ও রাশিয়া উভয়ের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্র নতুন শীতল যুদ্ধে জড়িয়ে গেছে। এই দ্বন্দ্বকে মার্কিন নেতারা গণতন্ত্র এবং কর্তৃত্ববাদের সংঘাত হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাঁদের সে চেষ্টা গন্ধ শুঁকে যাচাইয়ের পরীক্ষায়ই ব্যর্থ হয়েছে। এর কারণ হলো, তাঁরা একদিকে চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আনছেন, অন্যদিকে একই অভিযোগে অভিযুক্ত সৌদি আরবের মতো দেশের বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকছেন এবং তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখছেন। এ ধরনের ভণ্ডামি ইঙ্গিত দেয়, যুক্তরাষ্ট্র আসলে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় নয়; বরং বিশ্বব্যাপী তার আধিপত্য বিস্তারের মানসেই মানবাধিকার ইস্যুতে পক্ষপাতমূলকভাবে সোচ্চার হয়ে থাকে।

শীতল যুদ্ধের পর দুই দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশ্বে স্পষ্টতই ১ নম্বরে ছিল। কিন্তু তারপর মধ্যপ্রাচ্যে চালানো বিপর্যয়কর বিপথগামী যুদ্ধ, ২০০৮ সালের আর্থিক বিপর্যয়, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, করোনা মহামারি এবং অন্যান্য সংকট আমেরিকার অর্থনৈতিক মডেলের শ্রেষ্ঠত্বের ওপর ঘোর সন্দেহ জাগিয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো লোকের নির্বাচিত হওয়া, ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্পপন্থীদের চড়াও হয়ে অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করা, স্কুলে বা শপিং মলে ঢুকে বন্দুকধারীর নির্বিচার গুলি করে মানুষ মারার অসংখ্য ঘটনা, রিপাবলিকান পার্টির ভোটার দমনের চেষ্টা করা এবং কিউঅ্যানোন থিওরির (এটি একটি ষড়যন্ত্রতত্ত্ব। এই তত্ত্বে বিশ্বাসীরা মনে করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের অভিজাত শয়তান উপাসকদের বিরুদ্ধে এক গোপন লড়াই শুরু করেছেন। এ লড়াইয়ের মাধ্যমে হিলারি ক্লিনটনের মতো নেতাদের বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত) মতো ষড়যন্ত্রতত্ত্বে বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের উত্থানের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, আমেরিকার রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবন গভীরভাবে ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।

নিশ্চিতভাবেই আমেরিকা ক্ষমতা হারাতে চায় না। কিন্তু এটি অনিবার্য, চীন অর্থনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে। চীনের জনসংখ্যা শুধু যে আমেরিকার চেয়ে চার গুণ বেশি তা নয়; এর অর্থনীতিও অনেক বছর ধরে তিন গুণ দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে (প্রকৃতপক্ষে, চীন ইতিমধ্যে ২০১৫ সালে ক্রয়ক্ষমতা-জ্বালানি সক্ষমতা-সমতার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেছে)। যদিও চীন এখনো নিজেকে আমেরিকার জন্য কৌশলগত হুমকি হিসেবে ঘোষণা করার মতো কিছু করেনি, কিন্তু স্পষ্টতই পরিস্থিতি সেদিকে যাচ্ছে। ওয়াশিংটনে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী উভয় শিবির এ বিষয়ে একমত যে চীন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি কৌশলগত হুমকি তৈরি করতে পারে এবং সেই ঝুঁকি কমানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে চীনা অর্থনীতির বেড়ে ওঠার গতি থামাতে হবে।

রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করার আগেই ভালোভাবে এ নতুন স্নায়ু যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তারা তখন থেকেই সতর্ক করে আসছিলেন, যুদ্ধের কারণে যেন প্রকৃত দীর্ঘমেয়াদি হুমকি চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ কোনোভাবে সরে না যায়। কারণ, রাশিয়ার অর্থনীতির আকার অনেকটা স্পেনের সমান আর রাশিয়ার সঙ্গে চীনের যে ‘সীমাহীন’ অংশীদারত্ব আছে, সেটাও অর্থনৈতিকভাবে খুব কমই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় (যদিও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনায় রাশিয়ার জড়িত থাকার ইচ্ছা তার বৃহত্তর দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রতিবেশী চীনের কাছে হিতকর প্রমাণিত হতে পারে)।

কিন্তু ‘যুদ্ধরত’ একটি দেশের রণকৌশল প্রয়োজন এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে একা একটি নতুন বিরাট শক্তির প্রতিযোগিতায় জেতা সম্ভব নয়। সে জন্য তার মিত্র প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের আদি ও প্রাকৃতিক মিত্র হলো ইউরোপ। এর বাইরে আছে বিশ্বের অন্যান্য উন্নত গণতন্ত্র। কিন্তু ট্রাম্প সেই মিত্রদের বিচ্ছিন্ন করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে গেছেন এবং রিপাবলিকানরা এখনো তাঁর নীতি এমনভাবে অনুসরণ করে থাকেন যে অংশীদার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর যথার্থ ভরসা করা যায় কি না, তা নিয়ে মিত্রদের প্রশ্ন করার যথেষ্ট কারণ রয়ে গেছে। অধিকন্তু যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ এবং উদীয়মান বাজারের কোটি কোটি মানুষের হৃদয় ও মন জয় করতে হবে। এটি শুধু তার পাশে সমর্থক বাড়ানোর জন্য নয়, গুরুত্বপূর্ণ সম্পদগুলোতে তার প্রবেশাধিকার সুরক্ষিত করতেও এটি দরকার।
বিশ্বের আনুকূল্য পেতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক হারানো জায়গা পুনরুদ্ধার করতে হবে। সে ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের শোষণ করার দীর্ঘ ইতিহাস মোটেও সাহায্য করবে না। দেশটির গভীরে প্রোথিত বর্ণবাদ যা ট্রাম্প দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগিয়েছিলেন, তা–ও সেই হারানো জায়গা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কাজে আসবে না। অতি সম্প্রতি মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা বিশ্বব্যাপী ‘ভ্যাকসিন বর্ণবাদ’-এ যে ভূমিকা রেখেছেন, তা সাংঘাতিক সমালোচনার মুখে পড়েছে। তাঁদের বৈষম্যমূলক নীতির কারণে ধনী দেশগুলো তাদের প্রয়োজনীয় সব ডোজ টিকা নিয়েছে আর দরিদ্র দেশগুলোর লোকদের তাদের ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, আমেরিকার নতুন শীতল যুদ্ধের প্রতিপক্ষরা তাদের ভ্যাকসিনগুলো গরিব দেশগুলোর কাছে সহজে বা কম খরচে সরবরাহ করেছে। পাশাপাশি তারা সেসব দেশকে তাদের নিজস্ব ভ্যাকসিন-উৎপাদনব্যবস্থা বিকাশেও সহায়তা করেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার প্রতিপক্ষদের বিশ্বাসযোগ্যতার ব্যবধান আরও বিস্তৃত হয়েছে। এ ব্যবধান বৈশ্বিক দক্ষিণে থাকা দেশগুলোর, অর্থাৎ যাদের এ প্রভাব মোকাবিলা করার ক্ষমতা সবচেয়ে কম, তাদের ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রভাব ফেলেছে। প্রধান উদীয়মান বাজারগুলো এখন যদিওবা গ্রিনহাউস-গ্যাস নির্গমনের প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে, তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান নির্গমন এখনো যে কারও চেয়ে বেশি। উন্নত দেশগুলো তাদের নির্গমন বাড়িয়েই যাচ্ছে। আরও খারাপ দিক হলো ধনী বিশ্বের দ্বারা সৃষ্ট জলবায়ু সংকটের প্রভাব মোকাবিলায় দরিদ্র দেশগুলোকে সাহায্য করার জন্য তারা সামান্য প্রতিশ্রুতিও দেয়নি। উল্টো মার্কিন ব্যাংকগুলো অনেক দেশে ঋণসংকট সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে এবং সংকটে পড়া দেশগুলোর যন্ত্রণার প্রতি নিষ্ঠুর উদাসীনতা দেখিয়েছে।

কোনটি নৈতিকভাবে সঠিক এবং অর্থনৈতিকভাবে যৌক্তিক, তা নিয়ে অন্যদের নসিহত করার ক্ষেত্রে ইউরোপ এবং আমেরিকা বরাবরই শ্রেষ্ঠ। তবে তারা কাজের মাধ্যমে (যেমন নিজেরা কৃষি ভর্তুকি অব্যাহত রেখে অন্যদের কৃষি ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ দিয়ে থাকে) যে বার্তা দেয়, তা অনেকটা এ রকম, ‘আমি যা বলি তা করো, আমি যা করি তা করো না’। বিশেষ করে ট্রাম্পের ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত আমেরিকা আর নৈতিক উচ্চ স্থানে অবস্থানের দাবি রাখে না। তার পরামর্শ দেওয়ার মতো বিশ্বাসযোগ্যতাও এখন আর নেই। বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোতে নব্য উদারবাদী অর্থনীতি কখনোই ব্যাপকভাবে গ্রহণ করা হয়নি এবং এখন সর্বত্র এ উদারবাদী অর্থনীতির জনপ্রিয়তা পড়ে গেছে।

একই সময়ে চীন বক্তৃতাবাজির ক্ষেত্রে দক্ষতা না দেখিয়ে দরিদ্র দেশগুলোকে বৃহৎ অবকাঠামো দিয়ে সজ্জিত করার ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করেছে। হ্যাঁ, এ কথা ঠিক, এ দরিদ্র দেশগুলো প্রায়ই গভীরভাবে ঋণের জালে জড়িয়ে থাকে এবং চীন তার সুযোগ নিয়ে থাকে। কিন্তু উন্নয়নশীল বিশ্বে ঋণদাতা হিসেবে পশ্চিমা ব্যাংকগুলো এত দিন যে আচরণ করে এসেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যদের চীনের বিষয়ে অভিযোগের আঙুল তোলার মতো অবস্থা নেই। যুক্তরাষ্ট্র যদি নতুন শীতল যুদ্ধ শুরু করে থাকে, তাহলে সেই যুদ্ধে তাকে জিততে হলে কী কী লাগবে, সে বিষয়ে তার পূর্ণাঙ্গ ধারণা থাকতে হবে। শীতল যুদ্ধগুলোতে সব সময়ই শেষ পর্যন্ত প্রণোদনার আকর্ষণ এবং প্ররোচনার ‘সফট পাওয়ার’ এর জয় হয়। সেই বিবেচনায় শীর্ষে আসতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই বাকি বিশ্বকে কেবল তাদের পণ্য কিনতে উৎসাহিত করলে হবে না, বরং যুক্তরাষ্ট্র যে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ‘বিক্রি’ করে; তা কিনতেও তাদের রাজি করাতে হবে।

ইউক্রেনে যুদ্ধে রাশিয়া আসন্ন পরাজয় নিয়ে পশ্চিমের সব সংবাদমাধ্যম একজোট হয়ে যে খবর দিয়েছে তার প্রায় সিংহভাগই বানোয়াট। 
কীভাবে বিশ্বের সেরা বোমারু বিমান এবং ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা তৈরি করতে হয়, তা হয়তো যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে ভালো জানে, কিন্তু শীতল যুদ্ধে সেসব কাজে আসবে না। তার বদলে তাকে অবশ্যই উন্নয়নশীল এবং উদীয়মান-বাজারের দেশগুলোকে সুনির্দিষ্টভাবে সহায়তা দিতে হবে। কোভিড–সম্পর্কিত সব বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির ওপর একটি ছাড় দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে, যাতে তারা নিজেরাই ভ্যাকসিন উৎপাদন এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম তৈরি করতে পারে।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পশ্চিমকে আবারও তার অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বিশ্বের কাছে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। বন্দুক সহিংসতা হ্রাস করা, পরিবেশগত বিধিগুলো উন্নত করা, বৈষম্য এবং বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং নারীর প্রজনন অধিকার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে সেই ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার শুরু করতে হবে। যতক্ষণ না আমরা নিজেদের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য হিসেবে প্রমাণ করতে না পারছি, ততক্ষণ আমরা আশা করতে পারি না যে অন্যরা আমাদের ড্রামের তালে তাল দিয়ে কুচকাওয়াজ করবে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
● জোসেফ ই স্টিগলিৎজ নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ

প্রথম আলো

সর্বাধিক পঠিত


ভিডিও