খেলাধুলা

যে পাঁচ কারণে বিশ্বকাপ জিততে পারে ব্রাজিল

3603_download (6).jpg

বিশ্বকাপ ও ব্রাজিল—যেন চিরকালীন সম্পর্কযুক্ত দুটি নাম। প্রতি চার বছর পর বিশ্বকাপ এলেই ফেবারিটের প্রশ্নে নামটা অবধারিতভাবে উঠে আসে। ব্রাজিল! কেন? এ প্রশ্নের উত্তর না দিলেও চলে। দল যেমনই হোক, ব্রাজিল যে বিশ্বকাপের চিরকালীন ফেবারিট।

নভেম্বরে শুরু হতে যাওয়া কাতার বিশ্বকাপেও এর ব্যত্যয় ঘটছে না। চার মাস আগে থেকেই উড়ছে আশার রেণু, নেইমার এবার ঠিকই বিশ্বকাপ এনে দেবেন ব্রাজিলকে। যদিও সুপারকম্পিউটারে হিসাব-নিকাশ করে জুনের মাঝপথে ‘দ্য অ্যানালিস্ট’ জানিয়েছিল, কাতার বিশ্বকাপে ব্রাজিলের শিরোপা জয়ের সম্ভাবনা নেই।

কিন্তু ফুটবলপ্রেমীমাত্রই জানেন, ব্রাজিলের ক্ষেত্রে অন্তত বিশ্বকাপে এসব হিসাব-নিকাশ চলে না। ব্যাপারটা অনেকটাই যেন এমন, বিশ্বকাপ মানেই ব্রাজিল ফেবারিট। তাই বিশ্বকাপে ব্রাজিলের ফেবারিট হওয়ার প্রশ্নে আলাদা করে কোনো কারণ ব্যাখ্যা করতে হয় না। তবু নির্দিষ্ট করে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তো খুঁজে নেওয়াই যায়। চলুন, যে দেশের জন্য রানার্সআপ হওয়াটা ব্যর্থতা, তাদের বিশ্বকাপ জেতার সম্ভাবনা জাগানো পাঁচ কারণের কথা জেনে নেওয়া যাক।

১. নেইমার

পিএসজি তারকার বয়স এখন ৩০ বছর। গত বছর অক্টোবরেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, কাতার বিশ্বকাপের পরই জাতীয় দল থেকে অবসর নিতে পারেন। অর্থাৎ, ব্রাজিলের হয়ে এটাই যে নেইমারের শেষ বিশ্বকাপ, তা মোটামুটি ধরে নেওয়া যায়। এ পরিস্থিতিতে ১৯৭০ বিশ্বকাপের ব্রাজিল দলের সঙ্গে একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সেটা ছিল পেলের শেষ বিশ্বকাপ। তাঁর পাশে ছিলেন টোস্টাও, জর্জিনিও, গারসন, রিভেলিনো, ক্লদওয়ালদো ও কার্লোস আলবার্তোর মতো তারকা। পেলে যেমন সেই বিশ্বকাপে ব্রাজিলের মূল খেলোয়াড় ছিলেন, এবার নেইমারও ঠিক তা-ই।

তাঁর পাশে লুকাস পাকেতা, ভিনিসিয়ুস, রাফিনিয়া, কাসেমিরোরাও প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের নিয়ে নেইমার খুব স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বকাপ জিততে মরিয়া থাকবেন। কারণ, ১৯৭০ বিশ্বকাপের মতো এবারের ব্রাজিলও শক্তিতে পিছিয়ে থাকবে না, আর ত্রিশেই শেষ বিশ্বকাপ খেলা পেলের মতো নেইমারও ত্রিশেই থামতে চাইছেন। আলাদা একটা প্রেরণা তো থাকবেই।

এর পাশাপাশি আরেকটি বিষয় যোগ করা যায়; গত বছর অক্টোবরেই নেইমার বলেছিলেন, ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জেতানোই এখন তাঁর মূল লক্ষ্য। ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপজয়ী কিংবদন্তিদের যে লম্বা তালিকা, অবসর নেওয়ার আগে নেইমার সেখানে বিলক্ষণ নাম লেখাতে চাইবেন। সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত দক্ষতায় কমতি নেই তাঁর। ব্রাজিল-সমর্থকদের এখন অপেক্ষা শুধু বিশ্বকাপে নেইমার যেন ফিট এবং ফুরফুরে মেজাজে থাকেন। বাকিটা সময়ই বলে দেবে।

২. অভিজ্ঞতা ও ঐতিহ্য

সর্বশেষ বিশ্বকাপ পর্যন্ত মূল পর্বে অংশ নেওয়া মোট দলের সংখ্যা ৭৯। কিন্তু বিশ্বকাপ জিততে পেরেছে মাত্র আটটি দল—ব্রাজিল, জার্মানি, ইতালি, উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও স্পেন। চ্যাম্পিয়ন হওয়া এসব দলের মধ্যে শুধু ব্রাজিলই সব কটি বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলেছে। অর্থাৎ বিশ্বকাপে খেলার অভিজ্ঞতায় কোনো দলই ব্রাজিলকে পেছনে ফেলতে পারেনি। এ অভিজ্ঞতা কতটা দামি, তা বোঝা যায় দলটির সর্বোচ্চসংখ্যকবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ায়। বিশ্বকাপে ১০৯ ম্যাচে ৭৩ জয় নিয়েও সাফল্যে সবার ওপরে ব্রাজিল। যে দলের অভিজ্ঞতা এমন, শিরোপা জয়ের দৌড়ে তারাই যে এগিয়ে থাকবে, সে কথা না বললেও চলে। এখন প্রশ্ন হলো, এই ঐতিহ্য আর অভিজ্ঞতার মিশেলে ব্রাজিল কি সফলতা পাবে?

জয় যদি হয় অভ্যাস, তাহলে বলতে হবে তিতের দলে এমন ‘উইনার’ আছেন বেশ কয়েকজন। কাসেমিরো, ভিনিসিয়ুস, রদ্রিগোরা রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে লিগ ও চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের আত্মবিশ্বাস নিয়ে পা রাখবেন কাতার বিশ্বকাপে। গোলপোস্টে বিশ্বস্ত আলিসনও ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ভালো মৌসুম কাটিয়েছেন। নেইমার লিগ জিতেছেন পিএসজিতে, গ্যাব্রিয়েল জেসুস জিতেছেন ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে। তাঁদের বাইরে কুতিনিও, পাকেতা, রাফিনিয়া, আন্তনিওরা ইউরোপের লিগে যথেষ্ট অভিজ্ঞ। ইউরোপিয়ান দলের মুখোমুখি হতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় কুতিনিও-নেইমারদের। বিশ্বকাপ এলেই যেহেতু হিসাব হয় ইউরোপ বনাম লাতিন আমেরিকা—ব্রাজিলের এই দল সে হিসাবে পিছিয়ে থাকবে না।


৩. কাসেমিরো

কথায় আছে, একজন খেলোয়াড় দিয়ে কখনো বিশ্বকাপ জেতা যায় না। কথাটা ঠিক। আবার ভুলও। কেন ভুল, সে বিষয়ে যুক্তি দিতে পারেন ব্রাজিল কোচ তিতে। গত বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিল বনাম বেলজিয়াম ম্যাচটা নিশ্চয়ই মনে আছে? হলুদ কার্ডের নিষেধাজ্ঞায় ম্যাচটি খেলতে পারেননি ব্রাজিলের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার কাসেমিরো। সে সুযোগে ব্রাজিলের মাঝমাঠ ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলেন কেভিন ডি ব্রুইনা-এডেন হ্যাজার্ডরা। আর ৩১ মিনিটে ডি ব্রুইনার সেই গোলও নিশ্চয়ই মনে আছে? মাঝমাঠ দিয়ে রোমেলু লুকাকু বল নিয়ে প্রায় বিনা বাধায় ঢুকে পড়েছিলেন ব্রাজিলের বিপৎসীমায়। সেখান থেকে হজম করা গোলে বাদ পড়েছিল ব্রাজিল।


অনেকে মনে করেন, কাসেমিরো সে ম্যাচে থাকলে ফলাফলটা অন্য রকম হতে পারত। কারণ, কাসেমিরোর কাজই হলো প্রতিপক্ষের আক্রমণে বিপদ হওয়ার আগেই তা নস্যাৎ করে দেওয়া। বর্তমান ফুটবলে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড পজিশনকে বিশেষ গুরুত্ব দেন কোচরা। ২০২১ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে এ পজিশনে বিশেষজ্ঞ কাউকে না নামিয়ে শিরোপা হাতছাড়া করেছেন পেপ গার্দিওলা। এ পজিশনে বর্তমানে সবার সেরা তো কাসেমিরোই। এবার বিশ্বকাপেও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হতে যাচ্ছেন রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডাররা, আর সব দলই কাসেমিরোর মতো ‘ট্যাংক’ পাওয়ার স্বপ্ন দেখে। ব্রাজিলের তা আছে বলেই এগিয়ে।


৪. আক্রমণভাগে সমন্বয় ও ফর্ম

ব্রাজিলের খেলায় সাম্বানাচের সেই ছন্দ আর নেই—এ পুরোনো অনুযোগ বা অভিযোগ। এখন আর তা কেউ খণ্ডন করতে যান না, এমনকি স্বয়ং কোচ তিতেও আর সুন্দর ফুটবলের পূজারি বলতে সর্বস্ব দিতে রাজি নন। ফলই তাঁর কাছে শেষ কথা। নেইমার-ভিনিসিয়ুসরা সে অনুযায়ী খেলে টানা ১৩ ম্যাচ অপরাজিত থাকলেও কয়েক মাস ধরে একটি বিষয় দেখা যাচ্ছে। বলা ভালো, গত বছর কোপা আমেরিকা থেকে ব্রাজিলের খেলায় বিশেষ করে আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের মধ্যে বেশ ভালো বোঝাপড়া দেখা যাচ্ছে।

নেইমার একটু পেছনে খেললে তাঁর সঙ্গে লুকাস পাকেতার বোঝাপড়া, ওয়ান-টু পাসে ডিফেন্স ভাঙার চেষ্টা—এসব দেখে আশা খুঁজে নিতে পারেন সমর্থকেরা। বাঁ প্রান্ত থেকে ভিনিসিয়ুসের বল নিয়ে দৌড়ের সময় বাকিদের অব দ্য বল মুভমেন্টও দেখার মতো—মানে, প্রতিপক্ষের রক্ষণ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই জায়গা তৈরি করে দেয় দুর্দান্ত মুভমেন্টের কারণে।

ব্রাজিল সর্বশেষ যে বিশ্বকাপ (২০০২) জিতেছে, সেখানে দুই উইংব্যাক কাফু ও রবার্তো কার্লোসের (লেফটব্যাক হলেও ওভারল্যাপ করে সর্বক্ষণ ওপরে উঠে যেতেন) ভূমিকা ছিল অসামান্য। বিরতির পর বদলি হিসেবে দেনিলসন নেমেও প্রতিপক্ষকে ব্যস্ত রাখতেন। এবার দলে তেমন ফুলব্যাক না থাকলেও ভিনিসিয়ুস, রাফিনহা ও রদ্রিগোর মতো উইঙ্গাররা থাকায় দুই প্রান্ত দিয়ে আক্রমণে এগিয়ে থাকবে ব্রাজিল। আর মাঝে ত্রাস ছড়াতে তো নেইমার-পাকেতা আছেনই।


৫. শুধু নেইমারে ভরসা নয়

হ্যাঁ, কাতার বিশ্বকাপে নেইমারই ব্রাজিলের মূল তারকা। শুধু মূল তারকায় ভরসা রেখে কি বিশ্বকাপ জয়ের নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব? ফুটবল যেহেতু দলীয় খেলা, বেশির ভাগ সময় দল হিসেবেই খেলতে হয়। ২০১৪ ও ২০১৮ বিশ্বকাপে শুধু নেইমারের ওপর ভরসা রাখার ফল টের পেয়েছে ব্রাজিল। চোটের কারণে গত বিশ্বকাপে তো পুরো ফিট হয়েও খেলতে পারেননি পিএসজি তারকা। কথা হলো, এবারও যদি এমন কিছু হয়? গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে যদি নেইমারকে না পায় ব্রাজিল! তখন তো উতরে যাওয়ার পথ বের করতে হবে।
তিতে ঠিক এ বিষয়ই মাথায় রেখে কয়েক মাস ধরে কাজ করেছেন আক্রমণ নিয়ে। বৈচিত্র্য এনেছেন অ্যাটাকিং থার্ডে। সেখানে কখনো জেসুস, কখনো-বা নেইমারকে দেখা যায়। নেইমারকে ফলস নাইনে খেলানো হয়েছে। রাফিনিয়া-আন্তোনিওকে দিয়ে ডান উইং দিয়ে জায়গা বাড়াচ্ছেন, ভিনিসিয়ুসকে দিয়ে অবশেষে বক্সে ঢোকার লাইসেন্স দিয়েছেন। আর পাকেতাকে তো ‘একের মধ্যে তিন’ মিডফিল্ডার বানিয়ে ফেলেছেন ব্রাজিলের এই কোচ। আক্রমণ গড়া, রুখে দেওয়া এবং পাসে পাসে খেলানোর সঙ্গে বক্সের বাইরে থেকে চকিত শট—এসব অভ্যাস গড়ে ফেলেছেন পাকেতা।

অর্থাৎ, গোল করা ও করানোর দায়িত্বটা এখন আর শুধু নেইমারের একার কাঁধে নেই; গোলের নেশাটা আক্রমণভাগে প্রায় সবার মধ্যেই আছে। এর পাশাপাশি জায়গা পূরণ করা, যেমন—নেইমার বক্সের সামনে থেকে সরে ডানে কিংবা বাঁয়ে থাকলে বক্সের সামনে পাকেতা কিংবা অন্য কাউকে ওত পেতে থাকতে দেখা যায়। অর্থাৎ, পাস এলেই গোলে কিক নেবেন। আগের মতো বক্সে দাঁড়িয়ে থাকা স্ট্রাইকারকে বল দিয়ে গোলের কাজটা তাঁর কাঁধেই তুলে দিয়ে দায়িত্ব সেরে ফেলার দিন পাল্টেছে ব্রাজিল ফুটবলে।

সর্বাধিক পঠিত


ভিডিও