ইসলাম

হোলি আর্টিজান হামলা: যে প্রশ্নগুলো তোলা জরুরি

3645_ali reaz.jpg

হোলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলার ষষ্ঠ বার্ষিকীতে ‘সন্ত্রাসবাদ’, ‘জঙ্গিবাদ’ ও ‘সহিংস উগ্রবাদ’ বিষয়ে আলোচনা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন হবে, এটাই স্বাভাবিক। এসব আলোচনায় এ প্রশ্ন গুরুত্ব পাবে যে দেশে ২০১৬ সালের চেয়ে সন্ত্রাসী তৎপরতা হ্রাস পেয়েছে কি না এবং এ ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতা ও সন্ত্রাসী সংগঠন মোকাবিলায় সরকার সফল কি না। গত কয়েক বছরে দেশে ইসলামপন্থী আন্তর্জাতিক সহিংস গোষ্ঠীগুলোর হামলার ঘটনা ঘটেনি, দেশে এ ধরনের সংগঠনগুলোর সাংগঠনিক শক্তি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদবিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘২০২০ সালে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী তৎপরতা হ্রাস পেয়েছে’। এগুলো বাংলাদেশে সন্ত্রাস দমনে সরকারের সাফল্য বলেই প্রতিভাত হয়।

সন্ত্রাসী হামলার বিচারপ্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। বিশেষ ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং একজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা আপিলের সুযোগ পাবেন এবং সে বিবেচনায় বিচারপ্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। এ মামলার চার্জশিটে বলা হয়েছিল, ২১ জন এ হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন ওই দিন অভিযানে নিহত হন, পরে বিভিন্ন সময়ে নিরাপত্তা অভিযানে নিহত হন আটজন; বাকি আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ এই সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাটি কিন্তু অকস্মাৎ ঘটেনি, এর পটভূমি তৈরি হয়েছিল দীর্ঘদিন ধরেই। এ পর্যায়ের সূত্রপাত হিসেবে আমরা ২০১৩ সালকে চিহ্নিত করতে পারি। সে সময় থেকে সহিংস উগ্রবাদী সংগঠনগুলো পর্যায়ক্রমে শক্তি সঞ্চয় করতে পেরেছিল বলেই ২০১৬ সালের ১ জুলাই এবং সে সময়ের অন্যান্য হামলার ঘটনা ঘটেছিল।

লক্ষণীয়, হোলি আর্টিজান মামলার চার্জশিটে বা মামলায় সরকারি কৌঁসুলির বক্তব্যে এ পটভূমির বিষয়ে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। আইন-আদালত বিষয়ে অভিজ্ঞরা বলবেন যে এ মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা একটি অপরাধে যুক্ত, তাঁদের সেভাবেই বিচার হয়েছে, অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা মামলার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল না। আমি তাঁদের সঙ্গে একমত। কিন্তু কেন, কী পটভূমিকায়, কী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সহিংস উগ্রবাদী সংগঠনের উদ্ভব ঘটল, বিকাশ লাভ করল এবং দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা কম ধরনের ভূমিকা পালন করেছে, নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে এগুলোর তদন্ত হওয়া দরকার ছিল এবং এখনো আছে। যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এ দায়িত্ব বর্তায় সংসদের ওপরে, কিন্তু বাংলাদেশের সংসদে ক্ষমতাসীন দলের আধিপত্য এমন যে সেখানে নির্বাহী বিভাগের ভাষ্যকে প্রশ্নহীনভাবে গ্রহণ করাই হচ্ছে কাজ। ফলে এসব বিষয়ে না হয়েছে তদন্ত, না হয়েছে খোলামেলা আলোচনা।

এ ধরনের তদন্তের প্রয়োজনীয়তার নানা কারণের মধ্যে আছে অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং সংগঠনগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের যোগাযোগ থাকা না থাকার বিষয়। ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশে যেসব সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, তার দায় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদা ও আইএস দাবি করেছে আর সরকার তা অস্বীকার করে আসছে। ১ জুলাইয়ের হামলার ঘটনার সময় আইএসের পক্ষ থেকে তখনই তা প্রচার করা হয়েছে এবং পরেও তাদের ভিডিওতে বাংলাদেশ হামলা চালানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু সরকার এসব সংগঠনের উপস্থিতি অস্বীকার করার নীতি নিয়ে রাজনৈতিকভাবে এগুলোকে ব্যবহার করছে। এ ধরনের সংগঠনের বিস্তার দেশে প্রকৃত অর্থেই হয়েছিল কি না, সেটা জানার উপায় হচ্ছে এ বিষয়ে তদন্ত। বাংলাদেশে সহিংস উগ্রবাদ বিস্তারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের সূত্রপাত পুরোনো। আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে কথিত মুজাহিদদের লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারীরাই দেশে ফিরে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলাম বা হুজি গড়ে তুলেছিল। এ দেশে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর উৎসমুখ হচ্ছে হুজি।

২০১৪ সালে ইরাক ও সিরিয়ায় আল-কায়েদার শক্তি সঞ্চয় ও বিকাশ এবং ওই অঞ্চলে ইসলামিক স্টেটের উদ্ভবের সময় এ ধরনের আদর্শের অনুসারীরা বাংলাদেশে নতুন করে সংগঠিত হয়। বাংলাদেশে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর বিস্তারের যে একটি বৈশ্বিক পটভূমি রয়েছে, তা এভাবেও প্রমাণিত। এ অঞ্চলে এই দুই সংগঠনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা বিদেশি, শিয়াদের ওপরে হামলার মধ্য দিয়ে টের পাওয়া যায়। অন্যদিকে ২০১৮ সাল থেকে সিরিয়ায় আইএসের ক্রমাবনতি এবং ২০১৯ সালে তার পরাজয় বাংলাদেশে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর শক্তি হ্রাস করেছে।

তবে এই দুই সংগঠন বা তাদের আদর্শ সম্পূর্ণভাবে তিরোহিত হয়নি। পশ্চিম আফ্রিকায় আইএসের দুটি সাংগঠনিক কাঠামো সক্রিয়, তারপর আছে বোকো হারাম, একই অঞ্চলে আছে আল-কায়েদার অনুসারী জামাত নুসরাত আল-ইসলাম আল-মুসলেমিন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আইএসের শক্তি কেবল ফিলিপাইনেই সীমাবদ্ধ নয়; দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের পরে সেখানে আইএসের কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে, আল-কায়েদার সঙ্গে তালেবানের সখ্য আছে। পাকিস্তানে তেহরিক-ই-তালেবান এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। ভারতে হিন্দু সহিংস উগ্রপন্থাকে উসকানি দেওয়া তাদের সমর্থন দেওয়া ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের নীতিরই অংশ। এসবের প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে পড়বে। এ কারণেই বোঝা দরকার, অতীতে কীভাবে এ ধরনের সংগঠনের বিস্তার ঘটেছিল, সরকার ও রাষ্ট্রের কোন প্রতিষ্ঠান কী ভূমিকা পালন করেছে।

২০১৬ সালের এই হামলার পরে সরকার এ ধরনের সন্ত্রাসী সংগঠনের বিরুদ্ধে অনেক অভিযান চালিয়েছে। ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জমান খান জানান, ‘সিলেট, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গি আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ৮০ জন জঙ্গি নিহত হয়’ (যুগান্তর, ২১ নভেম্বর ২০২১)। এসব অভিযানের বিষয়ে গণমাধ্যমে সরকারি ভাষ্যের বাইরে কোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন চোখে পড়েনি। কোনো ধরনের তদন্তের কথাও সরকার বলেনি। নিহত ব্যক্তিদের সবাই সন্দেহাতীতভাবে ‘জঙ্গি’ ছিলেন কি না এবং এসব অভিযান যথাযথভাবে পরিচালিত হয়েছে কি না, দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো তা নিয়ে অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছে—এমনও জানা যায় না। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এর নামে সারা পৃথিবীতেই যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে, তাতে দেখা গেছে, বিভিন্ন দেশেই এর শিকার হয়েছেন অনেক নিরপরাধ মানুষ, অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা ভিন্নমতাবলম্বী। হোলি আর্টিজানে অভিযানের সময় আটক জাকির হোসেন শাওন পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তাঁর পরিবারের অভিযোগ হচ্ছে, আটকের পর শাওনের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর দায় কেউই স্বীকার করেনি।

গত কয়েক বছরে সরকারের কথিত ‘জিরো টলারেন্স’-এর উদাহরণ হিসেবে জঙ্গিদের আটকের কথা বলা হয়। কিন্তু কতজন ‘জঙ্গি’ অভিযোগে আটক হয়েছেন, এর কোনো নির্ভরযোগ্য হিসাব নেই। ২০২১ সালের জুন মাসে র‍্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর প্রায় দেড় হাজার জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে’ (প্রথম আলো, ২৯ জুন ২০২১)। নভেম্বরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছিলেন, প্রায় ৭ হাজার ২০০ জঙ্গি গ্রেপ্তার হয় (যুগান্তর, ২১ নভেম্বর ২০২১)। এরপরও প্রায়ই গণমাধ্যমে ‘জঙ্গি আটক’ বলে খবর প্রকাশিত হয়। সবাই যদি জঙ্গি হয়, তবে সরকারের দেওয়া এই সংখ্যা প্রমাণ করে যে এ ধরনের আদর্শে বিশ্বাসীর সংখ্যা নেহাতই কম নয়। আর তা না হলে বুঝতে হবে, কথিত জঙ্গি দমনের শিকার হচ্ছেন নিরপরাধ মানুষ।

ইতিমধ্যে যাঁরা আইনি প্রক্রিয়ায় দণ্ডিত হয়েছেন, তাঁদের কাছ থেকে এটা জানার চেষ্টা করা জরুরি যে তাঁদের মোটিভেশন বা প্রণোদনা কী ছিল। বিভিন্ন দেশে এ ধরনের গবেষণা হয়েছে, যেগুলো উগ্রবাদী চিন্তার উৎস বোঝা এবং সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে সাহায্য করেছে। হোলি আর্টিজান হামলায় অংশগ্রহণকারী এবং যাঁরা জঙ্গিবাদে যুক্ত বলে চিহ্নিত করা গিয়েছিল, তাঁদের এক বড় অংশই এসেছিল সচ্ছল, উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে, তাঁদের অনেকেই দেশে-বিদেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করেছেন এবং প্রযুক্তির ওপরে তাঁদের দখল আছে। এ আশঙ্কার কথা হোলি আর্টিজান হামলার আগেই আমি এক গবেষণায় তুলে ধরেছিলাম (হু আর দ্য বাংলাদেশি ‘ইসলামিস্ট মিলিট্যান্টস’, পারস্পেকটিভ অন টেররিজম, ফেব্রুয়ারি ২০১৬)। ২০১৬ সালে হামলার পরে এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হলেও সাম্প্রতিক কালে এ নিয়ে কথাবার্তা চোখে পড়ে না। এই শ্রেণির তরুণদের মধ্যে এই আদর্শের আকর্ষণ কি অবসিত হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি।

হোলি আর্টিজান হামলার বার্ষিকীতে কয়েক বছর ধরেই বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকেরা বলে আসছেন, বাংলাদেশের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে কার্যত পরাস্ত করার দৃশ্যমান সাফল্য সত্ত্বেও আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই। কিন্তু কেবল এটা বলাই যথেষ্ট নয়, দরকার হচ্ছে কঠিন প্রশ্নগুলো তোলা এবং আলোচনা করা। সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়েও সচেতন থাকা দরকার যে সন্ত্রাসবাদের প্রশ্ন যেন দলীয় রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহৃত বা নাগরিকের অধিকার হরণের হাতিয়ার না হয়।

● আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট

প্রথম আলো

সর্বাধিক পঠিত


ভিডিও