ইউরোপ

বাংলাদেশিসহ অবৈধদের ফেরাতে কঠোর ইউরোপ

776_download (4).jpg

ইউরোপীয় ইউনিয়নে এবার বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের রেকর্ড সংখ্যক অভিবাসী আশ্রয় নিয়েছেন। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে দুই হাজার সাতশ জন বাংলাদেশি প্রবেশ করেন। তারা সবাই প্রথমবার আশ্রয় আবেদন করেছিলেন। বিভিন্ন দেশের ৬০ হাজারেরও বেশি আশ্রয়প্রার্থী সেপ্টেম্বরে ইইউতে আশ্রয় আবেদন করেছেন।

সর্বমোট ৬০,৮১০ জন আশ্রয়প্রার্থী ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলোতে আন্তর্জাতিক সুরক্ষার জন্য প্রথমবারের মতো আবেদন করেছে। যাদের মধ্যে প্রায় ২৭০০ জন বাংলাদেশি নাগরিক।

ইনফোমাইগ্রেন্টসে উল্লেখিত ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুসারে, পুরো ২০২০ সালজুড়ে সমস্ত ইইউ সদস্য রাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক সুরক্ষা চাওয়া ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ৪,৭১,২৭০ হাজার। যা ২০১৯ সালের তুলনায় ৩২.৬ শতাংশ কম। সর্বশেষ ২০১৩ সালে ইইউতে এত কম সংখ্যক আশ্রয়পার্থী নথিভুক্ত হয়েছিলো।

এবার কঠোর হচ্ছে ইউরোপ। কারো আশ্রয় আবেদন প্রত্যাখ্যান হলে তাকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে আরও কঠোর হতে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে একমত হয়েছেন ইইউ নেতারা। বাংলাদেশের সঙ্গেও ইউরোপের আলোচনা চলছে দীর্ঘদিন ধরে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নে কারও বসবাসের অনুমতি না থাকলে সেই ব্যক্তিকে ফিরিয়ে নিতে তার দেশের ওপর চাপ বাড়াবে ইইউ। গত সপ্তাহে এক বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় কাউন্সিল। এজন্য ইইউর সংশ্লিষ্ট নীতি কাঠামোর পাশাপাশি দেশগুলোর সঙ্গে উন্নয়ন, বাণিজ্য ও ভিসা সংক্রান্ত বিদ্যমান সম্পর্ককেও শর্ত হিসেবে ব্যবহার করা হবে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যে চুক্তি আছে তা নবায়নের পাশাপাশি নতুন চুক্তির উদ্যোগ নেবে ইইউ।

যাদের ফেরত পাঠানো হয়

বর্তমানে ২০টিরও বেশি দেশের সঙ্গে ইইউর এ সংক্রান্ত চুক্তি রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, তিউনিসিয়া, আফগানিস্তান, নাইজেরিয়া, গিনি, আইভোরিকোস্ট, ইথিওপিয়া, গাম্বিয়া। এসব দেশের কোনো নাগরিকের ইউরোপে থাকার বৈধতা না থাকলে তাদের ফেরত পাঠায় ইইউ। বিশেষ করে কারো আশ্রয় আবেদন চূড়ান্তভাবে বাতিল করা হলে তাকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ। স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়াদের ক্ষেত্রে খরচ বহনসহ নিজ দেশে পুনর্বাসন প্রক্রিয়াতে দেওয়া হয় নানা ধরনের সহায়তা।

নিজ দেশের নাগরিকদের ফেরত নিতে সহযোগিতার বিনিময়ে দেশগুলোকে ইইউর পক্ষ থেকে ভিসা, বাণিজ্য, শিক্ষা ও উন্নয়ন সংক্রান্ত কিছু প্রণোদনা দেয়া হয়। বিপরীত কারণে এসব ক্ষেত্রে কোনো কোনো দেশের উপর কড়াকড়ি আরোপের বিধানও রয়েছে।

তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে অতিরিক্ত কঠোরতা অবলম্বন করছে বলে বিভিন্ন দেশের অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে গত বছর মরক্কোর সঙ্গে ইইউর দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। মরক্কোসহ আফ্রিকা থেকে আসা অভিবাসীদের একটি দলকে ফেরত নিতে ২০২০ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিল দেশটি।

যদিও মরক্কোর সঙ্গে তাদের এই সংক্রান্ত চুক্তি রয়েছে। ওই বছরের শেষে দেশটি সফরে যাওয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের একজন কমিশনার জানিয়েছিলেন, ২০২০ সালে ক্যানারি দ্বীপে আসা ১৯ হাজার অভিবাসীর অর্ধেকই মরক্কোর নাগরিক।

ফেরত পাঠানোর হার কম

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউরোপে বসবাসের অনুমতি না থাকাদের ফেরত পাঠানোর হার বেশ কম। ইউরোপীয় কমিশন এমন অভিবাসীদের অন্তত ৭০ শতাংশকে ফেরত পাঠানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলো ২০১৮ সালে। সেখানে ২০১৯ সালে মাত্র ২৯ শতাংশকে তারা ফেরত পাঠাতে পেরেছিলো।

চলতি বছরের শুরুতে ইউরোপীয়ান কোর্ট অব অডিটর্সের এক তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৫ সাল থেকে শুরু করে ২০২০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত আবেদন বাতিল হওয়াদের প্রতি পাঁচজনের মাত্র একজন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে নিজ দেশে ফেরত গেছেন।

ফেরত পাঠানোর এই প্রক্রিয়া আরও সুচারু করতে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নতুন একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে ইইউ। তবে এ নিয়ে সমালোচনাও আছে। বিশেষ করে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে দেশগুলোর উন্নয়ন সহায়তার বিষয়টিকে যুক্ত করার পক্ষপাতী নন কেউ কেউ।

ফেরত পাঠানো স্থায়ী সমাধান নয়

আশ্রয় আবেদন বাতিল হওয়া অনেক বাংলাদেশিকেও বিভিন্ন সময়ে ফেরত পাঠিয়েছে ইউরোপের দেশগুলো। এখনও অনেক অভিবাসী ফেরত আসার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন।

জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া জানান, ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৮১৬ জনের জন্য ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট’ ইস্যু করতে বাংলাদেশের প্রতি জার্মানি অনুরোধ জানিয়েছে। এদের মধ্যে অনেকে এরই মধ্যে জার্মানি ছেড়ে চলে গেছেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) বসবাসের অনুমতি নেই এমন বাংলাদেশিদের দেশে ফেরত পাঠাতে সহায়তা করতে বাংলাদেশ ও ইইউ এর মধ্যে ২০১৭ সালে ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরস’ (এসওপি) স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুসরণ না করলে বাংলাদেশের ওপর ইইউ ভিসা কড়াকড়ি আরোপ করতে পারে বলেও জানান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া।

বাংলাদেশের ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘ইউরোপে অনিয়মিত বাংলাদেশি কর্মী যারা রয়েছেন তাদের ফেরত পাঠাতে গত ১০ বছর ধরে আলোচনা চলছে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর ওপরে এই বিষযে কূটনৈতিক চাপ আছে। ২০১৭ সালে এই ধরনের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিলো যে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া না হলে ভিসা বন্ধ করে দেবে।’

তিনি বলেন, এই বিষয়ে বাংলাদেশ এরই মধ্যে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। কিন্তু তিনি মনে করেন অনিয়মিত অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর মধ্য দিয়ে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। এর সঙ্গে জড়িত মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সংকটও।

তার মতে, কত লোককে ফেরত পাঠানো যাবে তার চেয়েও জরুরি অনিয়মিত অভিবাসন বন্ধ করা। এজন্য আন্তর্জাতিক মানবপাচার বন্ধের পাশাপাশি অনিয়মিতভাবে আসা অভিবাসীদের সস্তা শ্রম ব্যবহার বন্ধে ইউরোপের দেশগুলোরও একমত হওয়া প্রয়োজন। সেইসঙ্গে বৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার প্রক্রিয়াগুলোর বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে। স্বেচ্ছায় ফিরে আসাদের যেসব সুবিধা দেওয়া হচ্ছে সেগুলোও জানাতে হবে।

বর্তমানে ইউরোপ থেকে বাংলাদেশে স্বেচ্ছায় ফেরত যাওয়াদের পুনর্বাসন সংক্রান্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুইটি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ব্র্যাক। এর মধ্যে গত চার বছরে ‘প্রত্যাশা’ নামের একটি প্রকল্পের আওতায় দুই হাজার জন ফিরে এসেছেন বলে জানান শরিফুল হাসান।

এদিকে ২০১৬ সালের পর প্রথমবারের মতো অনিয়মিত বাংলাদেশি অভিবাসীদের ফেরত পাঠাতে শুরু করেছে গ্রিস। গত সোমবার একটি চার্টার ফ্লাইটে করে ১৯ জনকে ঢাকায় বিতাড়িত করা হয়েছে। সোমবার গ্রিসের অভিবাসী ও শরণার্থীবিষয়ক মন্ত্রী নোতিস মিতারাচি নিজেই গণমাধ্যমকে এই তথ্য নিশ্চিত করেন।

এ বিষয়ে তিনি একাধিক টুইটও করেছে। সোমবার রাতে এথেন্স বিমানবন্দরে একটি ফ্লাইটের সামনে দাঁড়িয়ে গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সুরক্ষার আওতায় যারা নেই তাদের ফেরত পাঠাচ্ছে গ্রিস। আজকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। পাঁচ বছর পর আমরা আবারও বাধ্যতামূলকভাবে বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠাচ্ছি।

দেশটির গণমাধ্যম পলিটিসকিওস জানিয়েছে, এথেন্স বিমানবন্দর থেকে পোলিশ বিমান পরিবহন সংস্থা এন্টার এয়ারের একটি চার্টার ফ্লাইটে বাংলাদেশিদের পাঠানো হয়। ইউরোপের বহিঃসীমান্ত রক্ষাকারী সংস্থা ফ্রনটেক্সের সমন্বয়ে গ্রিক ও অস্ট্রিয়ান সরকার যৌথভাবে এই উদ্যোগ নিয়েছে বলে উল্লেখ করেছে আরেক সংবাদমাধ্যম কাথিমেরিনি।

এদিকে ঢাকার একটি সূত্র জানিয়েছে, সোমবার গ্রিস ছাড়াও অস্ট্রিয়া থেকে একজন ও মাল্টা থেকে চারজন অনিয়মিত বাংলাদেশি অভিবাসী ফেরত এসেছেন।

সর্বাধিক পঠিত


ভিডিও