সাহিত্য

লেখকদের নিয়ে যত ঘটনা-১৯: সায়ীদ স্যারের গল্পগুলো

1091_১.jpg

কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ঢাকা শহরে এসেছিলেন আশির দশকে রংপুর থেকে, পণ করেছিলেন লেখক হবেন। প্রখ্যাত লেখকদের অনেক মজার ঘটনার তিনি সাক্ষী। এই নিয়মিত কলামে তিনি বিখ্যাত মানুষদের জীবনের মজার ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণা করবেন। অন্য আলো ডটকমে এটি প্রতি মঙ্গলবার প্রকাশিত হচ্ছে।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের বহু বক্তৃতা শুনেছি। কখনোবা শ্রোতাদের আসনে বসে, কখনোবা তাঁর পাশে বক্তাদের সারিতে বসে। বহুবার স্যারের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। বৈঠকি আড্ডাতেও যোগ দিয়েছি তাঁর সঙ্গে। তাঁকে একবার রংপুর নিয়ে গিয়েছিলাম। ২০০৭ সালে। রংপুর জিলা স্কুলের ১৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করে। ঈদের ছুটিতে হয়েছিল সে অনুষ্ঠান। ঢাকা থেকে আরও গিয়েছিলেন সুবীর নন্দী আর মাহমুদুজ্জামান বাবু।

এখন লিখতে গিয়ে খানিকটা শোচনা বা লজ্জাই হচ্ছে। স্যারকে কষ্ট দিয়েছিলাম। আমার মনে আছে, আমাদের রংপুর জিলা স্কুলের একজন জুনিয়র ছাত্র—তানিম হুমায়ুন—এখন আমেরিকার বড় ইঞ্জিনিয়ার, ২০০৭-এ বোধ হয় বুয়েটেই পড়তেন, আমাকে বললেন, সায়ীদ স্যারের সঙ্গে কে যাবে? আমি বললাম, আমি তো বউ-বাচ্চা নিয়ে রংপুরে আগে যাব। তানিম বললেন, সায়ীদ স্যারের সঙ্গ যদি পাওয়া যায়, আমি স্যারের সঙ্গে এক গাড়িতে ঢাকা থেকে রংপুর যেতে চাই। পরে আবার তাঁকে নিয়ে ঢাকা ফিরব। তারপর আবার রংপুর যাব।

তানিম ভীষণ ভালো গল্প লেখেন। তানিম যে ভালো লিখবেন, তাতে সন্দেহ কী! সর্বশিষ্যে শিক্ষা দেন গুরুমহাশয়, শ্রদ্ধাবান লভে জ্ঞান, অন্যে কভু নয়। সায়ীদ স্যারের সঙ্গলোভে যিনি ঢাকা-রংপুর-ঢাকা-রংপুর চারটা ট্রিপ দিতে পারেন, তিনিই তো লেখক হবেন।

চ্যানেল আইয়ের ফরিদুর রেজা সাগর ভাইয়ের কাছ থেকে গাড়ি ধার চেয়ে স্যারকে গাড়ি করে রংপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তানিম স্যারের সঙ্গে এক গাড়িতে ছিলেন।
লজ্জা পাচ্ছি এই ভেবে যে প্লেনে কেন স্যারকে নিইনি! নাকি প্লেনেই নিয়েছিলাম, স্মৃতি প্রতারণা করছে! (রংপুরের আরিফুল হক রুজুকে ফোন করে জানতে পারলাম, তখনো সৈয়দপুরের বিমান সার্ভিস ঠিকঠাক হয়নি। এখন যেমন দিনে ৫/৬টা ফ্লাইট যায়, তখন তা একদমই ছিল না)।

স্যারকে আমরা একটা এনজিওর গেস্টহাউসে রেখেছিলাম। এখন সে জন্যও লজ্জা পাচ্ছি। খুব আহামরি কোনো গেস্টহাউস ছিল না সেটা।

আমি আমার লাল গাড়িটা আগেভাগে রংপুরে নিয়ে গিয়েছিলাম। যাতে স্যারকে রংপুরে ঠিকঠাক আনা-নেওয়া করা যায়। প্রথম আলো তখন আমাদের মারুতি সুজুকি ওয়াগন-আর ব্রান্ডের গাড়ি দিয়েছিল। কিন্তু আমার স্ত্রী চাকরি করেন, মেয়ে স্কুলে যায়, সে কারণে আমি একটা নিশান সানি এসই স্যালুন কিনেছিলাম ওয়াইন কালারের।
রংপুরে স্যার পৌঁছালেন। আমি তাঁকে নিতে গেলাম আমার নতুন গাড়ি নিয়ে। স্যার বললেন, গাড়িটা কার?
আমি বললাম, আমার।

স্যারের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল।
বললেন, তুমি এই গাড়ি কেন কিনেছ?
আমি বললাম, স্যার, আমার মধ্যে একটা হীনম্মন্যতা কাজ করে। আমার আম্মা চেয়েছিলেন আমি ইঞ্জিনিয়ার হই। আমি তা না করে সাংবাদিকতা করি। লেখক হতে চেয়েছি। আম্মা যেন মনে না করেন আমি কষ্টে আছি। তা-ই আমি গাড়ি কিনি। ফ্ল্যাট কিনি।

স্যার বললেন, এই জিনিসটার শেষ নেই। তুমি এখন এটা কিনেছ। এরপর মনে হবে, এর চেয়ে বড় গাড়ি দরকার। এর চেয়ে বড় ফ্ল্যাট দরকার। তুমি লেখক। তোমাকে প্রতিযোগিতা করতে হবে ভালো লেখার। নিজের সঙ্গে নিজের প্রতিযোগিতা। আমি কি আগেরটার চেয়ে ভালো লিখতে পারছি! আমি যা লিখি, তার চেয়ে কী করলে আরও ভালো লিখতে পারব!
আমি সায়ীদ স্যারের মধ্যে এই গুণটা দেখি। স্যার একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটে থাকেন। সেন্ট্রাল রোডে। সেই ফ্ল্যাটের লিফটে একসঙ্গে দুইজনের বেশি লোক উঠতে পারে না। স্যার চালাতেন একটা স্টেশন ওয়াগন। এসবের দিকে ‌স্যারের মোটেও খেয়াল নেই। কিন্তু স্যার যখন ঢাকার সবচেয়ে বড়লোক মানুষটার পাশে বসেন, গল্প করেন, স্যারকেই সুপিরিয়র মনে হয়!
এটা কোনো হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া ঘটনা নয়।

জিয়াউর রহমান স্যারকে ডেকে বলেছিলেন তাঁর মন্ত্রী/উপদেষ্টা হতে।
ওই সময় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করে ভীষণ জনপ্রিয়। ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীও জনপ্রিয়। ডা. বদরুদ্দোজা জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা/মন্ত্রী হয়েছিলেন।

স্যার বললেন, আমি আপনার অধীনে মন্ত্রী হতে পারব না।
জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, কেন?
স্যার জবাব দিয়েছিলেন, আমি শিক্ষক। আপনি সৈনিক। শিক্ষক হলেন ব্রাহ্মণ। সৈনিক হলেন ক্ষত্রিয়। ব্রাহ্মণ কখনো ক্ষত্রিয়ের নিচে থাকতে পারে না।
স্যারকে আমাদের রংপুরের বাসায় নিয়ে গেলাম। আমার বড় ভাই ডাক্তার আজহজারুল হকের বাসায় তখন প্রতি ঈদে আমরা সব ভাইবোন আর তাদের ছেলেমেয়েরা সমবেত হতাম।

স্যারকে আমাদের ছেলেমেয়েরা ঘিরে ধরল। স্যার আমাকে পরে বলেছিলেন, তোমাদের বাসাটাকে আমার মনে হয়েছে চাঁদের হাট।

একটা গোপন কথা এই ফাঁকে বলে রাখি। স্যার আমাকে এত স্নেহ করেন যে আমি কোনো আবদার করলে স্যার ‘না’ করতে পারেন না। প্রথম আলোর জন্যও স্যারের কাছ থেকে কোনো কিছু নেওয়ার (লেখা/সাক্ষাৎকার/উপস্থিতি) দরকার হলে সম্পাদক মতিউর রহমান—মতি ভাই আমাকে অ্যাসাইনমেন্ট দেন, আনিস, একটা কাজ করে দাও না, অমুক অনুষ্ঠানে সায়ীদ ভাইকে একটু এনে দাও না।

যেহেতু স্যার আমার অনুরোধ ফেলেন না, সেই জন্য আমি স্যারকে অনুরোধ করি কম। যেমন আমাদের আলতাফ শাহনেওয়াজকে বললাম, স্যারের কাছ থেকে কিশোর আলোর জন্য একটা লেখা এনে দাও।

আলতাফ বললেন, আপনি বলেন। তাহলে তো স্যার ‘না’ করতে পারবেন না।
আমি বললাম, সেই জন্যই আমি বলব না। স্যার যদি সত্যি সত্যি ‘না’ করতে চান, যেন করতে পারেন।

কিছুদিন আগের কথা। প্রথম আলো কিংবা কিশোর আলোর জন্য স্যারের একটা লেখা/জুম সাক্ষাৎকার লাগবে। স্যারকে বললাম। স্যার বললেন, আনিস, আমি খুবই ডিপ্রেসড অবস্থায় আছি। কোভিডে চারদিকে এত মৃত্যু! আমি এতটা ডাউন আর কখনো থাকিনি। আমাকে কি বাদ রাখতে পারো?

আমি বললাম, অবশ্যই পারি। ঠিক আছে স্যার। আমি আপনাকে জোর করতে চাই না।
রাত ১০টায় স্যার ফোন করলেন। আনিস, ভেবে দেখলাম, তোমাকে ‘না’ করা ঠিক হবে না। আমি করব।

প্রিয় পাঠক, আমি গভীরভাবে কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করি যে আমি এই জীবনে মানুষের ভালোবাসা অনেক পেয়েছি। বড় বড় মানুষের ভালোবাসায় আমার জীবন ধন্য।

করোনার মধ্যে জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার ফোন করে করে আমার কুশল জিজ্ঞাসা করতেন, আনিস, তুমি কেমন আছ, সাবধানে থেকো। আনিসুজ্জামান স্যার, না হলে মিসেস আনিসুজ্জামান ভাবি খোঁজ নিতেন। ফরিদুর রেজা সাগর ভাই নিজে চিকিৎসাধীন, ফোন করে করে খোঁজ নেন। এই তালিকা অনেক দীর্ঘ। বলে শেষ করতে পারব না। যেমন কবি মুহাম্মদ সামাদ। ফোন করে শুধু জানতে চাইবেন আমি ভালো আছি কি না। আমার স্ত্রী মেরিনা ভালো আছে কি না।

স্যারের বক্তৃতা শুনে সেটা থেকে কোনো একটা গল্প মুখস্থ করে আমি আমার বক্তৃতায় লাগিয়ে দিই। যেমন মানচিত্রের গল্পটা। এক ছেলে বাংলাদেশের মানচিত্র ছিঁড়ে ফেলল। বাবা বললেন, ‘জোড়া লাগাও।’ ছেলে জোড়া লাগাল। বাবা বললেন, ‘কী করে পারলে?’ ছেলে বলল, ‘এই ম্যাপের উল্টো পিঠে একটা মানুষের মুখ ছিল, আমি মানুষটাকে জোড়া লাগিয়েছি, দেশটা আপনা-আপনি জোড়া লেগে গেছে।’
আমরা যদি আমাদের মানুষগুলোকে গড়ে তুলি, দেশটা গড়ে উঠবে—আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন।
সায়ীদ স্যারের আরও গল্প বলব। আপনারা পড়তে থাকুন। (চলবে)

আনিসুল হক

প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক
প্রথম আলো

সর্বাধিক পঠিত


ভিডিও