জীবনের ১৪ টি বছর আত্মগোপনে থেকে নীরবে, নিভৃতেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হলো একসময়কার দাপুটে রাজনীতিক আলোচিত-সামালেচিত হারিছ চৌধুরীকে। গত সেপ্টেম্বর মাসের ৩ তারিখে ঢাকার একটি হাসপাতালে তিনি ইন্তিকাল করেন বলে এই প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন তার কন্যা সামীরা তানজীন চৌধুরী (মুন্নু)। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৬৮ বছর। তাকে ঢাকার কাছে একটি গোরস্থান দাফন করা হয়েছে। কিছু নিকটজন এবং ওলামা-মাশায়েখ অনেকটা গোপনে অনুষ্ঠিত এই জানাজায় শরিক হন।
বেশ কিছুদিন ধরে হারিছ চৌধুরীর চাচাতো ভাই আশিক চৌধুরী ফেসবুকে স্ট্যাটাসের মাধ্যমে হারিছ চৌধুরীর মৃত্যু বরণের কথা ইঙ্গিত করলেও সরাসরি কিছু বলেননি। তখন থেকে বিষয়টি আলোচনায়। পরে সাংবাদিকদের তিনি জানান হারিছ চৌধুরী লন্ডনে ইন্তিকাল করেছেন। ফলে কয়েকদিন ধরে হারিছ চৌধুরীর মৃত্যু নিয়ে ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়। জাস্ট নিউজের পক্ষ থেকে তার মেয়ে সামীরা তানজীন চৌধুরী মুন্নুর শরণাপন্ন হলে অনেক কষ্টে তাকে পাওয়া যায় এবং তিনি বিষয়টি খোলাসা করেন।
তিনি জানান, তার বাবা ঢাকাতেই ইন্তিকাল করেছেন।
এর আগে হারিছ চৌধুরীর অবস্থান নিয়ে ছিল নানান রকমের গুঞ্জন- কেউ কেউ বলে বেড়াতেন তিনি বৃটেনে, কেউ বলতেন আমেরিকা আবার কেউ ইরানে। কিন্তু সবার ধারণা ভুল প্রমাণিত করেছেন হারিছ চৌধুরী। স্বদেশেই থেকেছেন। তবে কখনো তাবলিগ জামাতের হয়ে দ্বীনের দাওয়াতে আবার কখনো করেছেন মসজিদে ইমামতি।
কথা হয় কন্যা সামীরার সাথে। আবেগ, অভিমান আর কষ্টের শেষ নাই তার। সে কী বুক ফাটা কান্না! শেষ গোসল, অন্তিম যাত্রা আর আতর গোলাপ ছিটিয়ে আন্তিম শয়ানে শুইয়ে দেয়ার কাজটি করেছেন স্বয়ং।
সামীরা বলেন, “সিলেটের কানাইঘাটে পারিবারিক গোরস্থানে দাদুর কবরের পাশে তাকে সামাহিত করার কথা। কিন্তু আশিক চাচা ( আশিক চৌধুরী ) সাহস করলেননা।”
হারিছ চৌধুরীর আত্মগোপনকালে তার পরিবারের খুব সামান্যই যোগাযোগ হয়েছে উল্লেখ করে সামীরা বলেন, “বাবা চাইতেন যা হয় তার উপর দিয়ে যাক। সন্তান হিসাবে আমাদের, আত্নীয়-স্বজন এমনকি তিনি যে রাজনীতি করতেন সেই রাজনৈতিক নেতৃত্বও যাতে তার কারণে কোনো বিপদে না পড়ে সে জন্য কারো সাথে কোনো যোগাযোগ রাখতেননা। মাঝে মধ্যে তিনি ফোনে সবার খোঁজ নিতেন। সর্বশেষ তিনি যখন আমাকে কাছে চাইলেন তখন সব শেষ”
সামীরা বলেন, “আমি কয়েক ঘন্টার নোটিশে সব ছেড়েছুঁড়ে ২৭ আগষ্ট ঢাকা পৌঁছাই। ততোক্ষণে তিনি লাইফ সাপোর্টে চলে গিয়েছেন। করোনা থেকে নিউমোনিয়া হয়ে মারাত্মক আঁকার ধারণ করে। বাঁচাতে পারলামনা বাবাকে। আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এক মুহুর্ত আড়াল করতে চাইনি। সবসময় তার পাশে বসেছিলাম। ভয় আর শংকা আমাদের সব তছনছ করে দিলো। মাত্র কয়েক দিন আগে ছোট চাচা ( সেলিম চৌধুরী) স্ট্রোক করে মারা গেলেন। তার আগে মারা গেলেন হাসনাত চাচা ( হারিছ চৌধুরীর ছোট ভাই), হারালাম এক ফুপু ও ৪ ফুপাকে। এমন বিপর্যয় আর কোনো পরিবারে হয়েছে কী না আমার জানা নাই।”
হারিছ চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পর্কে সামীরা বলেন, “এর সবটাই রাজনৈতিক। আমার বাবা হঠাৎ করে রাজনীতিতে আসেননি। ১৯৭৭ সাল থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেছেন, সিলেট জেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় যুগ্মমহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন।প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাকে যুবকদের সংগঠিত করার দায়িত্ব দিয়ে ছিলেন। ছিলেন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব। তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মতো রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের সাথে নিবিড় ভাবে কাজ করেছেন। সবকিছুকে ছাপিয়ে আমার বাবা ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। যিনি অস্ত্র হাতে দেশের জন্য লড়েছেন। তার সন্তান হিসাবে অবশ্যই আমি গৌরব বোধ করি।”
তার বিরুদ্ধে আনীত দূর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে সামীরা বলেন, “এসব অভিযোগ কোন্ শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে আসেনি, বলেন! এগুলোর ভিত্তিও আমাদের কারো অজানা নয়।পারিবারিকভাবে চৌধুরী পরিবার অসচ্ছল নয়। জন্মের আগে থেকে ট্রলারের ব্যবসা আর ছোট বেলা থেকে আমাদের গাড়ির শো-রুম দেখে আসতেছি। ঢাকা এবং সিলেটে বৃটিশ আমল থেকে আমাদের পরিবার ঐতিহ্য মন্ডিত। ক্ষমতায় থাকাকালীন গুলশানে একটি বাড়ি সরকারি নিয়ম অনুযায়ী রাজউক থেকে কিনেছিলেন যা সরকার পরবর্তীতে বাতিল করে ফেরত নিয়েছে। আর কী এমন আছে! আমার দাদা সিও (সার্কেল) অফিসার ছিলেন, এমএলএ ইলেকশনও করেছেন। তার সবছেলে মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। আমার বাবা নটোরডেম থেকে এইচ এস সি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং লোক প্রশাসনে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। আমাদেরকেও সুশিক্ষিত করে গড়েছেন। আমি আইন পাশ করে বৃটিশ গর্ভনমেন্ট লিগ্যাল ডিপার্টমেন্টের আইনজীবী হিসাবে কাজ করেছি। আমার ছোট ভাই নায়েম চৌধুরী (জনি) লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিকস থেকে মাস্টারস করে সিনিয়র এনার্জি ট্রেডার হিসাবে জুরিকে কাজ করছে।”
হারিছ চৌধুরীর মৃত্যু সংবাদ নিয়ে বিভ্রান্তি প্রসঙ্গে তার মেয়ে সামীরা চৌধুরী মুন্নু বলেন, “আমি ২২ বছর থেকে দেশের বাইরে।পরপর দুই চাচা ফুফু মারা গেলেন। এর বাইরে আমি তেমন কাউকে চিনিনা। আশিক চাচাই বাবার সাথে যোগাযোগ রেখে সব করতেন বলে জানি। দাদার নামে বাবার প্রতিষ্ঠিত এতিমখানা, মাদ্রাসা সব তিনিই দেখাশোনা করেন। আমার ভাইয়ের মাধ্যমে সহায়তা দেই। আমরা আশিক চাচার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। চাচাই মৃত্যু সংবাদটি প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছেন।”
লন্ডনে মারা গিয়েছেন বলে আশিক চৌধুরীর মন্তব্য প্রসঙ্গে সামীরা বলেন, “হয়তো কোনো চাপে বা পরিস্থিতির কারণে তিনি এমনটা বলে থাকতে পারেন। যে কারণে তিনি বলেছিলেন সিলেটে দাফন করা নিরাপদ হবেনা। আমার সাথে এবিষয়ে তার কোনো কথা হয়নি। আমার বাবার মতো একজন বিশাল ব্যক্তিত্বের মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরী হোক সেটা সন্তান হিসাবে আমার কাম্য হতে পারেনা, যোগ করেন সামীরা তানজীন চৌধুরী (মুন্নু)।
মুশফিকুল ফজল আনসারীর ফেসবুক স্টাটাস থেকে