লাইফ স্টাইল

কোরিয়ার সবচেয়ে বড় থিম পার্কে

1536_download (4).jpg

নভেম্বর থেকেই কোরিয়াতে ঠান্ডা পড়া শুরু হয়। ডিসেম্বর-জানুয়ারি তীব্র শীত থাকে। এসময় শীতের তাপমাত্রা অসহনীয় অনুভূত হয়। আর শীতে আসলে খুব বেশি আগ্রহ থাকে তুষারের প্রতীক্ষায়।

বৃষ্টির মতো কোন টাপুরটুপুর শব্দ নেই। পৃথিবীতে যেন কোথাও কিছু ঘটছে না, নিঃশব্দে তাণ্ডব চালিয়ে যায় প্রকৃতি। ঝিরঝির হালকা সাদা সাদা তুলোর মতো বিন্দু গায়ে লাগালে কেমন যেন একটা শীতল পরশ অনুভূতি হয়। শীতপ্রধান দেশ ছাড়া আর কেউ এ অসাধারণ উপলব্ধি নিতে পারে না, সে এক অদ্ভুত সুন্দর।

দক্ষিণ কোরিয়াতে চলছে টানা পাঁচদিনের নববর্ষের (সল্লাল) ছুটি। লম্বা ছুটিতে কোরিয় ও বিদেশিরা সাধারণত ঘুরতে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কিন্তু কোরিয়াতে হঠাৎ করোনাভাইরাস প্রকোপ বেড়ে গিয়ে প্রতিদিনই রেকর্ডসংখ্যক সংক্রমিত হচ্ছে। তারপরও স্বাস্থ্যবিধি মেনে দর্শনীয় স্থানগুলোতে দর্শনার্থীদের ভিড় চোখে পড়ার মতো।

এভারল্যান্ডের অনেক গল্প শুনেছি। এতোদিন মহামারী, সময় ও সুযোগের কারণে যাওয়া হয়নি। যদিও বাসা থেকে বাসে ২৫ মিনিটের রাস্তা! হঠাৎ কয়েকজন বন্ধু মিলে এভারল্যান্ড যাওয়ার পরিকল্পনা। তার আগের দিন সারারাত তীব্র তুষার পড়ে। রাস্তাঘাটে শুধু তুষারের স্তর। যতদূর চোখ যায় চারদিক ধবধবে সাদা।

সকালে চরম ঠান্ডা, ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গন্তব্য এভারল্যান্ড। সেখানে এক টিকেটে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সাধারণত কোরিয়ান ৫৬ হাজার উয়ন খরচ হয়। ভেতরে সব রাইড। কিন্তু আপনি যদি টিকেট আগে থেকে কিনে থাকেন বা বিসি ব্যাংক কার্ড থাকে তাহলে আপনি ছাড় পাবেন। আমরা বিসি ব্যাংক কার্ড দিয়ে ৫০% ছাড় পেয়েছি, যেখানে অ্যাডভেঞ্চার ম্যাজিক থেকে সবকিছু রয়েছে। জায়গাটা এতোটাই আকর্ষণীয় যে প্রতিবছর ৭০ লাখের বেশি দর্শনার্থী থিম পার্কটিতে ভ্রমণে আসে।

এভারল্যান্ড হলো দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম এবং বৃহত্তম থিম পার্ক যা ইয়ংইন শহরের অবস্থিত। এটি স্যামসাং গ্রুপ অব কোম্পানির মালিকানাধীন পরিচালিত। এভারল্যান্ড পাঁচটি থিম অঞ্চল নিয়ে গঠিত- গ্লোবাল ফেয়ার, জুটোপিয়া, ইউরোপিয়ান অ্যাডভেঞ্চার, ম্যাজিক ল্যান্ড ও আমেরিকান অ্যাডভেঞ্চার।

এ পার্কটিকে আগে বলা হতো ‘জায়েওন নংওয়ন’, যার অর্থ প্রাকৃতিক খামার। তার আগে ইংরেজি নাম ছিল ‘ইয়ংগিন ফার্মল্যান্ড’। এটা এমন একটি জগত যেখানে সারা বছর ধরে উৎসব চলতে থাকে। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে এ শীতে চারদিকে কৃত্রিম তুষার সাজিয়ে রাখা হয় এভারল্যান্ডে। প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করার মতো।

প্রতিটি ঋতুতে আছে বিভিন্ন ইভেন্ট। ‘টিউলিপ ফেস্টিভ্যাল’ (মার্চ-এপ্রিল) সুগন্ধি বসন্তের ঘ্রাণ, যেখানে সুন্দর টিউলিপসহ নতুন বসন্তের সূচনা হয় এবং পূর্ণ টিউলিপ বাগানসহ ফুল উৎসব হয়। ‘রোজ ফেস্টিভ্যাল’ (মে-জুন) গোলাপের ঘ্রাণে ভরা এভারল্যান্ডের রোমান্সে মুগ্ধকর পরিবেশ তৈরি করে। দিন থেকে রাত রঙিন গোলাপের মোহনায় নিজে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। ‘সামার স্প্ল্যাশ’ (জুন-অগাস্ট) হলো কাল্পনিক ভূতের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার সময়।

গ্রীষ্মের তাপে সেরা মুহূর্ত এভারল্যান্ডে জলে থাকার মজাই আলাদা। হ্যালোইন ও হরর নাইটস (সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর) বিশ্বের সবচেয়ে মজার হ্যালোইন পার্টি। ভয়ঙ্কর ভূত বন্ধুদের সঙ্গে হ্যালোইন উদযাপন রোমাঞ্চের একটি ভয়ংকর অভিজ্ঞতা তৈরি করবে। ‘ক্রিসমাস ফ্যান্টাসি’ (নভেম্বর-ডিসেম্বর) হলো সুন্দর আলো আর রূপকথার বাগান! এভারল্যান্ডে তখন তৈরি হয় উষ্ণ এবং রোমান্টিক ক্রিসমাস পরিবেশ। আর ‘স্নো ফেস্টিভ্যাল’ (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) এক কথায় অসাধারণ।
দূর দূরান্ত থেকে পরিবারের ছোট শিশুদের নিয়ে সময় কাটাতে প্রতিদিন থিম পার্কে ছুটে আসেন হাজার হাজার দর্শনার্থী। কী আছে এভারল্যান্ডে? এপ্রিল, ১৯৭৬ সালে একটি একক থিম পার্ক হিসেবে খোলা হয়েছিল এটি। গ্লোবাল ফেয়ার জোনের মাধ্যমে পার্কে প্রবেশ করা হয়। এভারল্যান্ডের সবচেয়ে বড় দোকান ‘গ্র্যান্ড এম্পোরিয়াম’।

কিন্তু ‘লাইভ হলোগ্রাম থিয়েটার’ এখানে একটি জনপ্রিয় আকর্ষণ। ভক্তরা মঞ্চে তাদের প্রিয় পপ তারকাদের হলোগ্রাম দেখতে পান। বিশাল ‘ম্যাজিক ট্রি’ রয়েছে গ্লোবাল ফেয়ারে। আমার চোখে দেখা সবাই সেই গাছের সঙ্গে প্রিয়জনকে নিয়ে ছবি তুলছে। এ গাছটি ঋতুর সঙ্গে তার রূপ পরিবর্তন করে ফেলে। মস্কোর ভেনিস সেন্ট বেসিল ক্যাথেড্রালের সেন্ট মার্কস প্লাজার বিখ্যাত বিশ্ব ল্যান্ডমার্কের মতো ভবনগুলোকে নকশা করা হয়েছে।

জু-টোপিয়ায় আছে একটি ছোট চিড়িয়াখানা। সাফারি পরিবহনে করে দেখা যায় বাঘ ও ভাল্লুকের মতো প্রাণী। দর্শনার্থীরা বাসে বসে উপভোগ করতে পারে। ইউরোপীয় অ্যাডভেঞ্চারে আছে ইউরোপীয় শৈলীতে অনেক রেস্তোরাঁ। এখানকার প্রিয় আকর্ষণ হলো ‘মিস্ট্রি ম্যানশন’ যেখানে দর্শনার্থীরা ভূতের দিকে গুলি ছুড়তে পারে। একটি বৃত্তাকার গাড়িতে চারজন পর্যন্ত বসতে পারে এবং প্রতি ব্যক্তি বাইরের দিকে মুখ করে থাকে, তাদের সঙ্গে থাকে বন্দুক। ভুতুড়ে-বাড়ির মতো পরিবেশের মধ্য দিয়ে যায় এটি যেখানে আপনার সামনে ভূত, কঙ্কাল ও পিশাচ দেখা দেবে। যে কোনো ভূতকে গুলি করা যায়, তার উপর একটি ছোট সবুজ আলো থাকে। যে মুহূর্তে কেউ এটিকে গুলি করে, সবুজ আলো লাল হয়ে যায় এবং সেই ব্যক্তির স্কোর বাড়ে। রাইডের শেষে স্ক্রিনে প্রদর্শিত সর্বাধিক পয়েন্ট রয়েছে যার তিনি জিতবেন।

এভারল্যান্ডের আরেকটি জনপ্রিয় আকর্ষণ ‘টি এক্সপ্রেস’। ২০০৮ সালের মার্চ মাসে এ রাইড যুক্ত করা হয়। কোরিয়ার প্রথম রোলার-কোস্টার যা সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এটি সর্বোচ্চ ও দ্রুততম কাঠের রোলার-কোস্টার, যার সর্বোচ্চ গতিবেগ ১০৪ কিলোমিটার। এ রোলার-কোস্টারে রাইড করতে চেয়েছিলাম, লাইনেও দাঁড়িয়েছিলাম। উপর থেকে নিচে এতটাই ঢালু সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম। সাহস দেখাতে পারলাম না। মনে হয় হেরে গেলাম। আশা করি অন্য এক সময় সাহসের পরিচয় দেবো।
ম্যাজিক ল্যান্ডে আছে ‘ঈশপের গ্রাম’, যেখানে চরিত্র ও থিম ঈশপের কল্পকাহিনি থেকে আঁকা হয়েছে। রয়েছে ভবিষ্যত উড়ন্ত রাইড ও রোবট রাইড৷ আর আমেরিকান অ্যাডভেঞ্চারে রয়েছে আমেরিকান ইতিহাস। এখানে পাওয়া যায় স্ন্যাক বাস্টার, এভারল্যান্ডের সুস্বাদু কোরিয়ান খাবার। আমরা সন্ধ্যায় স্ন্যাক বাস্টার খেয়েছিলাম, এ সুস্বাদু খাবারটি মাছ দিয়ে তৈরি।

ভ্রমণের জন্য শীতকালের যেকোনো সপ্তাহের দিন ভালো, আপনি যদি দীর্ঘ লাইন পছন্দ না করেন এবং ঠান্ডাকে কিছু মনে না করেন। তাহলে শীতের যেকোনো সপ্তাহের দিন এভারল্যান্ডে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত সময় হতে পারে। তবে ক্রিসমাস এবং নববর্ষ ছাড়া গেলে অতিরিক্ত ভিড় এড়িয়ে চলতে পারবেন। আমরা নববর্ষে গিয়েছিলাম, তাই চরম ঠান্ডা, করোনাভাইরাস আতংক ও ভয় কাজ করেছে। এভারল্যান্ড বিশাল জায়গা নিয়ে গঠিত, পাহাড়ি এলাকাজুড়ে বিস্তৃত যার জন্য প্রচুর হাঁটাও হয়েছে।
আপনি যদি ডিজনিল্যান্ড খুঁজে পাওয়ার আশায় এভারল্যান্ডে যান তাহলে হতাশ হবেন। এটি ডিজনিল্যান্ড বা ইউনিভার্সাল স্টুডিওর মতো একটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের চেয়ে আঞ্চলিক থিম পার্কের গুণমানের কাছাকাছি।

সর্বাধিক পঠিত


ভিডিও