লাইফ স্টাইল

অপারেশন স‍্যান্ড ব‍্যাংক আইল্যান্ড

2192_download (4).jpg

সুন্দর মসজিদ। ভেতরে তো ভালো, আশপাশেও কোন ময়লা-আবর্জনা নেই। মৌলভী সাহেবের নেই চুলচেরা নেকি-বিশ্লেষণের কোন দীর্ঘ বয়ান। মালদ্বীপের ধর্মীয় মূল্যবোধটা খুব পছন্দ হয়েছে। এখানে অধিবাসীদের প্রায় ৯৯% মুসলমান। কিন্তু ধর্মপালনের নেই কোনো বাহুল্য, নেই জীবনের প্রত্যহিকতার সঙ্গে কোন বিরোধ।

ধর্মকে এরা ধর্মের কঠোর খোলসের মধ্যে আবদ্ধ রাখেনি। এখানে ধর্ম পালন প্রাত‍্যহিক জীবনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, ঠিক যেমন ইসলামের সূচনাপর্বে ছিল। যে যুবক নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হলো, সে জীবিকার জন্য বিকিনি পরা যুবতীকে পাঁজাকোলা করে সাঁতার বা স্নোরকেলিং শেখাচ্ছে। কই, কেউতো চোখ রাঙাচ্ছে না!

নারীরাও বোরকা-হিজাবের আড়ালে প্রফেশনালিজম বজায় রেখে যে যার কাজ করে যাচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই, হোটেল রিসেপশনে বসা দ্রাবিড় চেহারার ভদ্রমহিলার হিজাবের আড়ালের মুচকি হাসি এতই শক্তিশালী ছিল যে, রিখটার স্কেলে ১০ মাত্রার সুনামির তীব্রতা ভেদ করে অধমের প্রৌঢ় কলিজাটা পারে তো কয়েক খণ্ড করে ফেলে! এই প্রাকৃতিক রমণীয়তা, এই সৌন্দর্য, সেতো সৃষ্টিকর্তারই দান। এ হাসির ব্যঞ্জনার সঙ্গে ধর্মীয় মূল্যবোধ কোথায় সাংঘর্ষিক সে আমি কিছুতেই ভেবে পাই না।

আমার তাড়া আছে। যেতে হবে অ্যাডভেঞ্চার রাইডিং-এ। সকাল সাড়ে আটটায় উপস্থিতি। হোটেলের গ্রাউন্ড ফ্লোরে কম্প্লিমেন্টারি বুফে ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা। তোফা! তোফা!! অল্পের মধ্যে বেশ মুখরোচক মজাদার আয়োজন। মনে রাখার মতো।

তড়িঘড়ি চলে এলাম সল্ট বিচে। যেখান থেকে আয়োজন করা হয়েছে ফুল-ডে অ্যাডভেঞ্চার রাইডিং। আছে স্নোরকেলিং, ডলফিন এবং শার্ক হাইকিং, সল্ট বিচ সৈকতে অ্যাডভেঞ্চার ভিজিট ইত্যাদি।

গতকালই ৭৫ ডলারে প‍্যাকেজ বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। সল্ট বিচ অ্যাডভেঞ্চার রাইডিং অফিস রুমে বসলাম। এখানে দুজন বাংলাদেশি ছেলে কাজ করে। একজন ময়মনসিংহের আসলাম, বাইরে খদ্দের আকর্ষণে ব‍্যস্ত থাকে। অন‍্যজন বরিশালের মুলাদির তারেক, ক‍্যাশ সেকশনসহ এজেন্সির টেকনিক্যাল দিকটা দেখাশোনা করে। এটা বেশ চটপটা। দেখলাম বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের সঙ্গে অনর্গল ইংরেজিতে বাতচিত করে যাচ্ছে। সমুদ্রের রাইডিং উপকরণ, যেমন হাঁসের পায়ের মতো জুতা, লাইফ জ‍্যাকেট, স্নোরকেলিং মাস্ক, তোয়ালে ইত্যাদি পর্যটকদের সরবরাহের সময় ভদ্রভাবে খানিক ধমকা-ধমকিও করল। এটা খোয়া গেলে এত ডলার, ওটা খোয়া গেলে এত ডলার জরিমানা এসব। বিদেশিদের সুদূর পরবাসে একজন বাঙালি ধমকাতে দেখে বুকের কোন গোপন কোণে একটুখানি কি অহংকার জেগে উঠল!

গ্রুপ ছাড়া এ ধরনের প্যাকেজ অ্যাডভেঞ্চার রাইডিং আয়োজন সম্ভব নয়। খরচ এবং নিরাপত্তার বিষয় জড়িত। প্রায় চৌদ্দ-পনেরো জনের গ্রুপ। কয়েকটি তরুণ-যুগল, ছেলে-মেয়েসহ ভারতীয় একটা পরিবার, তিন-চারজন একাকী তরুণ-তরুণী। এর মধ্যে আমিই একমাত্র বাঙালি সিঙ্গেল। সময় হলে যে যার জিনিসপত্র নিয়ে পোর্ট থেকে স্পিডবোটে উঠে পড়লাম। নীল সমুদ্রের বুক চিরে তীব্র বেগে ছুটে চলছে স্পিডবোট। সামনে-পেছনে দুপাশে মনোহারি দৃশ্য অনবরত বিদ্যুৎগতিতে আসা-যাওয়া করছে। সামনের সিটে বসা চেকোস্লোভাকিয়ার তরুণী বোটের পাশে হাত বাড়িয়ে আনন্দের আতিশয্যে অনবরত পানি ছিটিয়ে যাছে। সমন্থা না কি যেন নাম বলল। মাইনিং টেকনোলজিতে গ্রাজুয়েশন শেষ করে পরবর্তী ধাপে যাবার আগে একা একা ঘুরতে বেরিয়েছে।

ব্যাপারটা চমৎকার। আমরা যখন সংসার সমাজের গ্যাড়াকলে ঘুরপাক খেয়ে খেয়ে কোনো রকমে জীবনের প্রাণপাখি টিকিয়ে রাখায় ব্যস্ত ছিলাম, সেই বয়সেই এরা বিশ্ব মানচিত্রে নিজের অস্তিত্বটাকে পুরোপুরি ঠাহর করে ফেলেছে। জীবনের শুরুতেই বিশ্ব-সংসারের পাঠ যেন এদের মুখস্থ। এ নশ্বর পৃথিবীতে সময়টা যে সীমাবদ্ধ এবং সেটা ব্যবহারের সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব যে তার নিজের, এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আস্থাহীন নয় এরা।
গ‍্যাঞ্জাম কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। যাচ্ছি অ্যাডভেঞ্চার রাইডিং, স্নোরকেলিং-এ। তা গ্রুপে আফ্রো-ইন্দো-ইউরোপিয়ান যারা পিছু নিয়েছে মাশাল্লাহ্ তারা বেশিরভাগই দেখছি উড়নচন্ডি। উঁচু মিউজিকের তালে তাল সামলাতে বেতাল-বেশামাল অবস্থা। মা-মেয়ে-ছেলে, পড়শি তরুণ-তরুণী সবাই ডিসকো ড‍্যান্সার। নিজের চোখ না হয় মুদে রইলাম, ক‍্যামেরার চোখ কি আর কথা শোনে!

এদিকে নাচানাচির মধ্যেই আরেক ফ‍্যাসাদ। হঠাৎ করে সমুদ্রের নীল শাড়ি ভেদ করে প্রায় এক ব‍্যাটেলিয়ান ডলফিন সেনা স্পিডবোটের দুই পাশে সারিবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় মার্চপাস্ট শুরু করে দেয়। ক্ষণিকের জন‍্য কেমন রাজা-বাদশা বনে গেলাম। শুনেছি সেকালে এবং একালে রাজন‍্যবর্গ খরচপাতি করে বেতনভুক্তদের দিয়ে এসব করে ক্ষমতার ভাব নেয়। আমাদের কোন খরচ বা ক্ষমতার প্রয়োজন হয়নি। একদম স্রেফ স্বেচ্ছাশ্রমে মার্চপাস্ট-এসকর্ট অনুষ্ঠানের সফল সমাপ্তি ঘোষণা করে অভিবাদন জানিয়ে ডলফিনগুলো বিদায় নেয়। তবে ঘটনার আকস্মিকতায় মার্চপাস্টের উত্তেজক মুহূর্তগুলোর ছবি তুলতে ব‍্যর্থ হই।

কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা একটা প্রায় নির্জন ছবির মতো দ্বীপে যাত্রাবিরতি করি। ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো, যাকে আমরা হালে জনি ডেপের অবয়বে চিনি, ষোল শতাব্দীর কোনো এক সময় হয়তো এরকম একটি রহস্যময় দ্বীপের উপকূলে তার জাহাজ ভিড়িয়েছিল। প্রথম দৃষ্টিতেই মনে হয় দ্বীপের আনাচে-কানাচে, ভেতরে-বাইরে, রহস্য আর রহস্য। সারি সারি নারকেল বীথি, জানা-অজানা বৃক্ষরাজি, বালুকাময় সর্পিল অভ্যন্তরীণ পথ, স্থানীয় অধিবাসী, সবই যেন রহস্যে ঢাকা একটা অজানা জগত।

ভ্রমণসঙ্গীদের পেছনে রেখে আমার সেলফিভ্রমণসঙ্গীদের পেছনে রেখে আমার সেলফিবোট থেকে আমরা স্বচ্ছ পানিতে নেমে পড়ি। একটুপরই দেখি অদূরে পানির ভেতর থেকে বিশালাকৃতির একটা কালো জন্তু এঁকেবেঁকে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আমরা ভয়ে লাফ দিয়ে তীরে উঠে আসি। সঙ্গের গাইড বলল, ভয়ের কিছুই নেই। ওটা শার্ক, খুবই ফ্রেন্ডলি। চকিতে শরৎবাবুর ইন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ল ‘ও কিছু না, সাপ!’, আসলেই তাই। আমরা সাহস পেয়ে আবারও পানিতে নামলে বিশালাকার দু’তিনটি শার্ক, শাপলা পাতা মাছ, আরও ছোট বড় নাম না জানা রং-বেরঙের মীন পর্যায়ক্রমে স্বল্প পানিতে অবস্থান করে অভিযাত্রী দলকে স্বাগতম-শুভেচ্ছা জানিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গী কিছু তরুণ-তরুণী ওদের সঙ্গে জলকেলিতে মেতে উঠল। আমি এই ফাঁকে শুভ্র বালুকাবেলায়, নিঝুম বনবীথির আশপাশ ঘুরে এলাম। ভেতরে ঢুকতে সাহস হয়নি, কি জানি এখনও ওখানে নাঙা তলোয়ার হাতে জ্যাক স্প্যারোর কোন সঙ্গী-সাথী ওত পেতে আছে কিনা!

রহস্যদ্বীপ ছেড়ে আবার যাত্রা। এবার মাঝ সমুদ্রে কি কারণে যেন স্পিডবোট স্লো করল। চকিতে চেয়ে দেখি লাখ লাখ না হলেও নিদেনপক্ষে হাজার হাজার বিভিন্ন রঙের, বিভিন্ন আকৃতির বিশাল শার্ক আমাদের বোট ঘিরে ধরছে। বিস্ময়ে ভয় পাওয়ারও সুযোগ পেলাম না। অথৈ সমুদ্রে এদের সঙ্গেই নাকি আমাদের জলকেলি করার ব্যবস্থা। মরণ আর কি! মাঝ সমুদ্রে এক দঙ্গল শার্কের সঙ্গে কেলা-কেলি, খুনসুটি, ভাবা যায়! বিভিন্ন রঙের বিভিন্ন আকৃতির গ‍্যাদা, জোয়ান, বুড়ো সব যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। স্পিডবোটে পেছনের দিকে এজেন্সির একটা ছেলে সঙ্গে আনা খাবার দিচ্ছে। সেখানে একেবারে মাছবাজারে ডালির উপর শিং মাছ যেমন কিলবিল করে ঠিক সেভাবেই শার্কগুলো কিলবিল করছে। কে এদের  খবর দিলো, কোথা থেকে এলো, কিছুই মালুম হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সমুদ্রটা ওরা বিভিন্ন প্রদেশে ভাগাভাগি করে নিজেদের রাজ্য সীমানা চিহ্নিত করে রেখেছে। কোথাও ডলফিনের রাজ্য, কোথাও শার্ক রাজ‍্য, কোথাও টুনা মাছের সাম্রাজ্য। আসলে এদের বলা হয় ‘নার্স শার্ক’। সমুদ্রের অন্য এলাকায় নাকি আবার হিংস্র শার্কও দেখা যায়।

যাই হোক, এবার ফাইনাল অপারেশন। ডুবুরির পোশাক পরে গভীর জলে শার্ক-অ্যাডভেঞ্চার। মনটা খুঁতখুঁত করলেও নারীদের তোড়জোড় দেখে ভীতু হওয়ার পৌরুষ দেখাতে শরম লাগলো। পোশাক পরে গাইডের তত্বাবধানে দিলাম ঝাঁপ। এবার বয়সের ব‍্যাপারটা টের পেলাম। হাঁসের পায়ের জুতো দিয়ে সাঁতার কাটবো কি, এতো ভারি মনে হচ্ছে যেন নিচের দিকে টানছে। ওদিকে শার্কগুলো এসে গুতোগুতি শুরু করছে। সবাই আনন্দযজ্ঞে পানির নিচে শার্কের সঙ্গে লুকোচুরি জড়াজড়ি খেলছে। বিশেষ করে তরুণ যুগলদের আনন্দ দেখার মতো। পানির নিচের বিশেষ ক‍্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা হচ্ছে। বিকিনি পরা সঙ্গীকে বগলদাবা করে শার্ক রাজ‍্যের গভীর জলে প্রণয়-গাঁথার স্বর্গসুখ বাকিটা জীবন নিশ্চিত ওদের স্মৃতিপটে মুক্তোর মতো জ্বলে থাকবে।

আমার তো তেমন বাকি কিছু নেই, তাই শার্কগুলোকে কয়েকটা ঠেলা-ধাক্কা মেরে তারুণ্যকে সালাম জানিয়ে তাড়াতাড়ি বোটে উঠে পড়ি। এবার সমুদ্রের নীল কেটে কেটে কিছুদূর যেতেই দেখি দূরে মাঝ দরিয়ায় ছোট্ট একটি সাদা বিন্দু। আরও কাছে গিয়ে দেখি প্রায় ২০০ মিটার লম্বা ২৫ মিটার চওড়া শুভ্রবালুর চাদরে ঢাকা একটা দ্বীপের মতো। কোন গাছপালা নেই। শুধু বালু আর বালু। চারদিক থেকে সমুদ্রের ঢেউ গর্জন করে করে আছড়ে পড়ছে। বোট থেকে অগভীর জলে নেমে স‍্যান্ড ব্যাংক অ্যাডভেঞ্চারে উঠে পড়ি। চারদিকে উর্মিমালার নৃত্য-গীত-গর্জনে নিজেকে নিজের ভেতর ধরে রাখা দায়।
সেজন্যই বোধহয় আবার দেখতে হলো উচ্ছসিত আধুনিক রাধা-কৃষ্ণদের জলতরঙ্গে জলবিহার। ভারতীয় পরিবারের সদস্যরা তুমুল নাচানাচি করে ড্রোন উড়িয়ে কায়দামতো ভিডিও, ছবি ইত্যাদি রেকর্ড করে নিলো। স্মৃতি তুমি কতই না সুখের। তরুণ যুগলেরা ইচ্ছেমতো ঢেউয়ে-ডাঙ্গায় রোমান্টিক ফ্যাশন শো করে স্মৃতি-সঞ্চয়ের ডালাখানি পূর্ণ করছে, এ যেন বিপ্লবের গানের- মূর্ছনা।

সর্বাধিক পঠিত


ভিডিও