সাহিত্য

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: আলোর দিশারী

3928_download (11).jpg

তার অনেক পরিচয়। নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে একটা পরিচিত ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তাকে আমরা সবাই স্যার বলি। তিনি সকলের শিক্ষক। তিনি শিক্ষকদের শিক্ষক। তিনি আমাদের পরম প্রিয় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তিনি লেখক-প্রবন্ধিক। তিনি সাহিত্য আন্দোলনের পুরোধা। তিনি টেলিভিশনের বিখ্যাত অনুষ্ঠান সপ্তবর্ণর উপস্থাপক। তিনি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি আলোচিত মানুষ কারিগর। দেশব্যাপী বইপড়া কর্মসূচির স্বপ্নদ্রষ্টা। আমাদের রুচি নির্মাণের পথ প্রদর্শক।

বহু পরিচয় তার। সব পরিচয় ছাপিয়ে একটি পরিচয় প্রধান হয়ে ওঠে। তিনি শিক্ষক। শুধুমাত্র শ্রেণিকক্ষের শিক্ষক নন। তিনি আমাদের জীবন ও কর্মের শিক্ষক। আমরা অনেকেই তার ক্লাস রুমের ছাত্র নই। কিন্তু তিনি আমাদের শিক্ষক। আমাদের স্যার। সারাজীবন আমরা তার কাছ থেকে শিখেছি। আজও সেই শিক্ষা অব্যাহত আছে। আমাদের জীবন যাপন, কর্মপদ্ধতি, আমাদের রুচিশিক্ষা, সৎ ও শুভ চিন্তার ধারা। সবই তার কাছ থেকে শিখে থাকি। টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাণেরও বহুকিছু আমরা তার কাছে শিখেছি। তার কাছে উপস্থাপনা করার সহজ পদ্ধতি আয়ত্ত করার চেষ্টা করেছি। বক্তৃতা কত মধুরভাবে দেয়া যায় সেই শিক্ষাও সায়ীদ স্যারের কাছ থেকে পেয়েছি। যখনই চারপাশে রুচির অভাব দেখি, খারাপ মানুষের লম্ফঝম্প দেখি তখনই সায়ীদ স্যারের কথা মনে পড়ে যায়। বই পড়ে আমরা অন্ধকার থেকে আলোয় যেতে পারি। বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। একমাত্র বই-ই আমাদের জ্ঞান রাজ্যের প্রবেশদ্বারে উপনীত করে। এই সমস্ত ভাবনার উৎসমূল আমাদের কাছে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।

স্যারকে নিয়ে কিছু বলতে গেলে, লিখতে গেলে সব এলোমেলো হয়ে যায়। স্যারের সামনে আমি অধিকাংশ সময় চুপচাপ থাকি। স্যারের সঙ্গে কোনো রেকর্ডিং বা কোনো অনুষ্ঠান মঞ্চে উপস্থিত থাকলেও আমি খুব সংকুচিত থাকি। আমার মুখ দিয়ে কথা বের হয় না। স্যারের ৮০ তম জন্মদিন বেশ কয়েক বছর আগে পালিত হলো। কিন্তু তারপর আমি আর স্যারের কত তম জন্মদিন সেটা মনে রাখি না। স্যার সুস্থ সবল দেহে বিরাজমান তো বয়স নিয়ে কেন ভাবব? স্যার চিরতরুণ। চির যুবক। আজ ২৫ জুলাই স্যারের জন্মদিন। জন্মদিনের এই শুভক্ষণে কত কথাই না মনে পড়ছে। একজীবনের অনেক স্মৃতি। দুএকটা উল্লেখ করা যাক-

২.
গল্পটা স্যারের কাছ থেকে শোনা। একদিন সায়ীদ স্যার টেলিভিশন অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে যে অমানবিক পরিশ্রম করতে হয় সেই গল্প বলেছিলেন।

উপস্থাপককে অনেক দায়িত্ব নিয়ে কথা বলতে হয়। অনর্গল মুখে যা এলো বলে ফেললাম তার নাম উপস্থাপনা নয়। স্যার বললেন, অর্থসহ প্রাসঙ্গিক কথা বলাই উপস্থাপনা। উপস্থাপনা মানে ব্যক্তিত্বের সুন্দর প্রকাশ। সবাই জানেন, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ অসাধারণ বক্তা। তার বক্তৃতা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে। সেই সায়ীদ স্যার তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান শুরু করেছেন। নাম চারুপাঠ। আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষাদান এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য। শিক্ষা মানে কিছু মজাদার তথ্য উপস্থাপন।

সেই অনুষ্ঠানে উপস্থাপনার লিংকের জন্য সায়ীদ স্যার রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করবেন। কবিতাটি হলো:

বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের ওপর
একটি শিশির বিন্দু।

কবিতাটি সবারই প্রায় মুখস্থ। দেখা হয় নাই চুক্ষু মেলিয়া পংক্তিটা প্রায় প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছে। কিন্তু কবিতাটার নাম কি? কোন কাব্যগ্রন্থে কবিতাটি আছে? কবিতাটির কি আরও পংক্তি আছে? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন স্যারের মনে। পুরোপুরি না জেনে তো কবিতাটা উপস্থাপনায় উল্লেখ করা যাবে না।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের শিক্ষার্থীদের অনেককে স্যার জিগ্যেশ করলেন। কেউ সঠিক তথ্য দিতে পারল না। সায়ীদ স্যার টেলিভিশনেও অনেকের সঙ্গে আলাপ করলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার কেউ সঠিক তথ্য উপাত্ত দিতে পারল না। কবিতাটা সম্পর্কে সবারই ভাসা ভাসা ধারণা। এই জনপ্রিয় কবিতাটার মূল বিশ্লেষণ করে কেউ ব্যাখ্যা দিলো না।

সায়ীদ স্যার প্রতিটা তথ্য যাচাই বাছাই না করে কখনো কথা বলেন না।

কবিতাটা তিনি উপস্থাপনায় ব্যবহার করবেন কিনা খুব সংশয়ে পড়ে গেলেন। যে কোনো কথাই তো বলে ফেলা যায়। কিন্তু তার গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে। যে কথার কোনো ওজন নাই সেই কথা টেলিভিশনে বলে খুব লাভ হবে না।
চৈত্রের এক বিকেলে সায়ীদ স্যার তৎকালীন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আমতলায় বসে আছেন। তার দুই প্রিয় ছাত্র আমীরুল আর মাযহার সাথে আছে। চারুপাঠ অনুষ্ঠানে আমীরুল ছিল প্রধান সহকারী। স্যার বললেন,

কিহে কবিতাটার কোনো কুল-কিনারা হলো?
না স্যার।

হাঁ- তোমরা তো আর রবীন্দ্রনাথ পড়লে না মন দিয়ে। কীভাবে কি হবে? একদিন দেখা যাবে এই সমাজে কেউ নেই যে রবীন্দ্রনাথকে কিছুটা জানে। জনপ্রিয় কয়েকটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকবেন। কবি রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে কোনো আগ্রহ থাকবে না।

তারপর সায়ীদ স্যার বললেন,
চলো সনজীদা আপার বাড়ি যাই।

সনজীদা আপা মানে বিখ্যাত সনজীদা খাতুন। সায়ীদ স্যারের ছোট্ট ফিয়াট গাড়িতে মাযহার আর আমীরুল চড়ে বসল। স্যার নিজে ড্রাইভ শুরু করলেন। টিএসসি পার হয়ে ফুলার রোডে এলেন। শিক্ষকদের আবাসস্থল। চারতলা দালান। সামনে পেছনে মাঠ। দূরে টিনশেডে গাড়ি রাখার গ্যারেজ। স্যার গাড়ি পার্কিং করলেন। তারপর গাড়ির চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে বললেন,
চলো আপা তো থাকেন তিনতলায়।

স্যার তিনতলা পর্যন্ত উঠলেন। শান বাঁধানো সিঁড়ি। সায়ীদ স্যার সনজীদা খাতুনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,
থাক চলো চলে যাই। আপা খুব মেজাজী মানুষ। আমাদের সরাসরি শিক্ষক। কখন কী বলে ফেলে ঠিক নাই। এই বয়সে আর বকা খেতে ভালো লাগে না।

আমীরুল আর মাযহার অবাক হয়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে। স্যারকে এমন বিব্রত হতে কখনো দেখেনি তারা।
সায়ীদ স্যার কয়েক পা নামলেন। আবার দরজার দিকে তাকালেন।

না। আপা ছাড়া রবীন্দ্রনাথকে কে আর তেমন করে পড়েছে। চলো যাই, আপার কাছে যাই। আর মনজুরে মাওলার কাছে। মাওলাও রবীন্দ্রনাথকে পুরো আত্মস্থ করেছে।

সায়ীদ স্যার আপার ড্রইংরুমে বসে আছেন। হালকা সবুজ রঙের শাড়ি পরনে। নিপাট চেহারা। লাবণ্যমাখা মুখশ্রী। কিন্তু কিছুটা এলোমেলো অবস্থা আপার।

সায়ীদ কিছু মনে করো না। আমার এক নিকট আত্মীয় মারা গেছেন। তাই নিয়ে ঝামেলায় আছি। কেন এসেছিলে?
সায়ীদ স্যার আসল কথা না বলে ১৯৬১ সালের রবীন্দ্র বিরোধী আন্দোলনের গল্প শুরু করলেন। তারপর আপাকে বললেন,
আপা আপনার বাসায় ছাত্র বয়সে গান শুনতে আসতাম। আমি আর মান্নান সৈয়দ। আপনার মনে আছে?

আপার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি।

হাঁ। মনে আছে। অপ্রচলিত রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে শোনাতাম। তোমরা খুব আগ্রহী শ্রোতা ছিলে।

সনজীদা আপা কিছুটা মুডে এলেন বোঝা গেল। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার তার অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র। এক প্লেট সন্দেশ এলো স্যারের কাছে। আমীরুল ও মাযহার সলজ্জ ও কুণ্ঠিতভাবে স্যারের পেছনে বসে আছে।

সায়ীদ স্যার তখন বললেন, আপা বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে- কবিতাটি কোথায় পাবো?
আপা গম্ভীরভাবে তাকালেন স্যারের দিকে।

এটা পূর্ণাঙ্গ কোনো কবিতা নয়। এটা রবীন্দ্রনাথ বালক সত্যজিৎ রায়কে অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন। সত্যজিৎ রায় তখন শান্তিনিকেতনে পড়তে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সত্যজিৎ রায়কে ডাক নাম মানিক বলেই ডাকতেন। কারণ সত্যজিৎ রায়ের বাবা ছড়া সম্রাট সুকুমার রায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অনুজ বন্ধু। সেই মানিক’কে অটোগ্রাফ দিতে গিয়ে এই অমর পংক্তিগুলো রবীন্দ্রনাথ লিখে দেন।

তারপর সনজীদা খাতুন গভীরভাবে সায়ীদ স্যারকে বললেন,
সায়ীদ, তোমরা কেউই ভালো মতো রবীন্দ্রনাথ পাঠ করলে না। করা উচিৎ ছিল।
সায়ীদ স্যার মাথা নামিয়ে রইলেন।

পরে আমীরুল আর মাযহার সত্যজিৎ রায়ের ‘আমার ছেলেবেলা’ বইটায় এই অটোগ্রাফের সত্যতা খুঁজে পায়।
ওরা সায়ীদ স্যারকে সত্যজিৎ রায়ের ‘আমার ছেলেবেলা’ বইটার সেই অংশটুকু দেখায়। তখন সায়ীদ স্যার কবিতাটা সম্পর্কে পূর্ণভাবে নিশ্চিত হলেন। এবং চারুপাঠ অনুষ্ঠানের উপস্থাপনায় যথাযথভাবে সেই কবিতাটা ব্যবহার করলেন।

৩.
সায়ীদ স্যারের জন্মদিনে, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রতি বছর পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। করোনা সংকটের কারণে দুই বছর ধরে সেটা স্থগিত আছে। আমি জানি, জন্মদিনের উৎসব পালনে স্যার খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। খুব বিব্রতভাবে। মঞ্চে লাজুক শিশুর মতো বসে থাকেন। আমাদের কণ্ঠ থেকে ঝরতে থাকে প্রশংসা ও স্মৃতিগদ্য। স্যার তখন আরও লজ্জা পেতে থাকেন। করোনা সংকটে স্যার সেই লজ্জাজনক পরিস্থিতি থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছেন। করোনায় গৃহবন্দী থাকলেও তিনি আমাদের মন ও মননেই থাকেন সবসময়। স্যারের জন্মদিনের এই শুভ মুহূর্তে একটাই প্রার্থনা, স্যার যেন শতায়ু হোন। এ শুধু কথার কথা নয়। সায়ীদ স্যারকে খুব প্রয়োজন এই পৃথিবীর জন্য। বাংলাদেশের জন্য। কোটি কোটি জ্ঞানচর্চার আগ্রহী ছাত্রছাত্রীর জন্য।

রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে। কে আমাদের পরিত্রাণ করবে? কে আমাদের আলোর পথ দেখাবে? স্যারই তো আমাদের আলোর দিশারী।

স্যার, আপনাকে আবার জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

ফরিদুর রেজা সাগর-এর বই 'প্রিয় মানুষ' থেকে

সর্বাধিক পঠিত


ভিডিও