আয়েশা ফয়েজ তার প্রথম বই ‘জীবন যে রকম’ লিখেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে বসে। আত্মজীবনীমূলক এ বইয়ে জীবনসংগ্রামের নানা বিষয় উঠে এসেছে। দ্বিতীয় বই ‘শেষ চিঠি’ তার মৃত্যুর দুই বছর পর প্রকাশিত হয়।
বই: শেষ চিঠি, লেখক: আয়েশা ফয়েজ, প্রচ্ছদ: আহসান হাবীব, প্রকাশনী: তাম্রলিপি, পৃষ্ঠা: ৬৬, মূল্য: ১৬০ টাকা
সন্তানের জন্য মা নিজের প্রাণের মায়া পর্যন্ত করেন না৷ এমন উদাহরণ অনেক আছে পৃথিবীতে৷ কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের (১৯৪৮-২০১২) মা-ও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না।
তাই সন্তানকে হারিয়ে মা আয়েশা ফয়েজ (১৯৩০-২০১৪) ভীষণ মুষড়ে পড়েছিলেন। তারপর হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলম। অনেকটা স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে নিজের সন্তানের সঙ্গে কথা বলেছেন লেখার মাধ্যমে।
আয়েশা ফয়েজের জন্ম ১৯৩০ সালের ২৩ মার্চ। ১৯৪৪ সালে ফয়জুর রহমান আহমেদের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন তার স্বামী পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান। তিন ছেলে ও তিন মেয়ের মা আয়েশা ফয়েজ। তার প্রথম বই ‘জীবন যে রকম’ লিখেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে বসে। আত্মজীবনীমূলক এ বইয়ে জীবনসংগ্রামের নানা বিষয় উঠে এসেছে। দ্বিতীয় বই ‘শেষ চিঠি’ তার মৃত্যুর দুই বছর পর প্রকাশিত হয়।
বইটির ভূমিকায় আয়েশা ফয়েজের মেয়ে ও হুমায়ূন আহমেদের বোন সুফিয়া হায়দার লিখেছেন, “আমাদের বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ মারা যাবার পর মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। সব সময় অস্থির থাকতেন। কী করলে একটু ভালো থাকবেন, আমরা ভেবে পেতাম না। হঠাৎ একদিন দেখি একটি ছোট রুলটানা খাতায় গুটি গুটি করে মা কী যেন লিখছেন। সবাই খুব অবাক হলাম। এরকম মানসিক অবস্থায় মা কী লিখছেন? মাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘আমি তোদের দাদাভাই এর সঙ্গে কথা বলি।’ মা লিখে লিখে তার আদরের ছেলের সঙ্গে প্রতিদিন কথা বলতেন।”
এ বইয়ে আয়েশা ফয়েজ একমনে লিখে চলেছেন নিজের ব্যক্তিগত অনুভবগুলো। আর সেটা করতে গিয়ে অনেক বিষয়ই একাধিকবার এসেছে। লেখার মধ্যে ধারাবাহিকতা নেই। সময়ের হিসাবও ঠিক নেই। অনেক ক্ষেত্রেই বিষয়বস্তুর সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক অনেক কথা লিখেছেন। কিন্তু একটা বিষয় লক্ষণীয়, একজন মা তার সন্তানকে হারিয়েও কারও প্রতি বিষোদগার করেননি, সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। সবাইকে ধন্যবাদ দিয়েছেন তার সন্তানের যত্ন নেওয়ার জন্য, অকৃত্রিম ভালোবাসা দেওয়ার জন্য।
বইয়ের প্রত্যেকটা বাক্যে প্রকাশ পেয়েছে একজন সন্তানের জন্য মায়ের ভালোবাসা। বইটি পড়তে পড়তে কখন যে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে পাঠক টেরই পাবেন না। আসলে মায়েরা তো এমনই! বলা হয়ে থাকে, ‘বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ অনেক ভারি’। এ বইয়ে প্রকাশ পেয়েছে মায়ের কাছে সন্তানের মৃত্যুও অনেক বেশি কষ্টের। বইটার প্রথম বাক্য এমন, “আমার এত আদরের বাচ্চাটি আমাকে ছেড়ে তুমি কোথায় গেলে?” সন্তানহারা মায়েরা যুগে যুগে ঠিক এভাবেই প্রশ্ন করে গেছেন, যদিও জানেন এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য তার সন্তান আর ফিরে আসবে না। এরপর মা আবার লিখেছেন, “বাবা, তোমার কি একবারও মনে হয় নাই যে তোমার একটা দুঃখী মা আছে, একটা সুন্দর দেশ আছে, তোমার ভাই-বোনগুলো তোমার আশায় অপেক্ষা করছে৷ দেশের মানুষ তোমাকে কী-ই না ভালোবাসে!”
মা যেন তার সন্তানকে ফিরে পেতে চান যে কোনো কিছুর বিনিময়ে। আয়েশা ফয়েজ লিখেন, “বাবা, মৃত্যুর জন্য কতকাল থেকে আমি অপেক্ষা করে আছি।...আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য যত খতম আছে সব পড়েছি। প্রথম দিন থেকে সদকা দিয়েছি। ছাগল দিয়েছি, গরু দিয়েছি, মুরগি তো প্রায়ই দিতাম। সাতটা সুস্থ সবল মুরগি দিয়েছি একসঙ্গে। শুনেছি একসঙ্গে সাতটা সদকা দিলে আল্লাহ দয়া করেন।...তোমার যখন অপারেশন হচ্ছে তখন আমি এক বৈঠকে ১০৪ রাকাত নামাজ আদায় করেছি।”
সন্তানের অন্তিম সময়ে মা ঠিকই টের পেয়ে গেলেন যে তার সন্তানের অমঙ্গল হতে চলেছে। বইয়ের ভাষায়, “একদিকে মা, অন্যদিকে ছেলে, মাঝখানে একটা পৃথিবী, এর থেকে বড় কষ্ট বুঝি আর কিছু নাই।...কিন্তু যেদিন তুমি আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে যাবে সেদিন দেখি আমি কিছুতেই শান্তি পাই না।...আমার জ্ঞান আছে, আমি বুঝতে পারছি, বাবা, এই হচ্ছে তোমার চিরবিদায়।”
সন্তানের মৃত্যুর পর মায়ের মনে অনেক ধরনের চিন্তার উদ্রেক ঘটেছে। কখনও মনে হয়েছে আমার আদরের সন্তান কি আমার উপর রাগ করেছিল? আবার কখনও ফুটে উঠেছে সন্তানের শেষ সময়ে তার পাশে না থাকার আক্ষেপ। ছেলে হুমায়ূন আহমেদকে উদ্দেশ করে আয়েশা ফয়েজ লিখেন, “আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, বাবা, তুমি কি আমার উপর রাগ করে গিয়েছ? তোমাকে একবারও স্বপ্নে দেখি না কেন? আমি যদি তোমার ওপর কোন অন্যায় করে থাকি সেটা না জেনে করেছি। না বুঝে করেছি। তুমি আমার উপর রাগ করে থেকো না বাবা। ...আমি বেঁচে থেকেও আমার অসুস্থ ছেলেটিকে গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম না। কী খায় দেখলাম না। কেমো নিয়ে অসুস্থ শরীরে কীভাবে চলাফেরা করে, কিছুই দেখলাম না।”
সন্তান হারানোর পর মায়ের মনে কতশত সম্ভাবনা উঁকি দিয়ে যায়। মনে হয় এটা করলে হয়তোবা তার সন্তান বেঁচে থাকতো, সেটা করলে হয়তোবা তার সন্তান সুস্থ হয়ে উঠতো। ছোটবেলায় একবার হুমায়ূন আহমেদ শখ করে রোজা রেখেছিলেন, কিন্তু বেলা তিনটার দিকে তার খিদে পেয়ে গেল। তখন মায়ের কাছে এসে বললেন, ‘আপনি আমাকে কেন রোজা রাখতে দিলেন?’ তার উত্তরে মা বলেছিলেন, তুমিই তো রোজা রাখতে চাইলে! ছেলে বলেছিলেন, ‘আমি চাইলেই আপনি রাখতে দিবেন কেন?’
ছেলের চিকিৎসার বিষয়টা নিয়েও তাই মায়ের মনে প্রশ্ন উঠেছিল। মা লিখেন, “আমার এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, চিকিৎসার জন্য ঢাকা ছিল, সিঙ্গাপুর ছিল, অথচ তুমি গেলে আমেরিকায়। আমি কেন তোমাকে যেতে দিলাম? তুমি কি সেই ছোটবেলার মতো আমাকে বলতে চেয়েছিলে, আমি না-হয় যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আপনি কেন আমাকে যেতে দিলেন?”
সন্তান মারা যাবার পর মায়ের মনের পর্দায় বারবার ভেসে উঠছে সন্তানের জন্ম থেকে শুরু করে পুরো জীবনের ছবি- “তোমার জন্মের পর একটা খুশির বন্যায় ভেসে গেছি। আমাদের পূর্বপুরুষের আমলে যত মালী, তেলী, ধোপা, নাপিত থাকত পরিবারে কোন সন্তান হলে তারা এসে নাচ-গান করে বকশিস নিত। তোমার জন্মের সময়ও তাই হলো।” প্রয়াত সন্তানের সব স্মৃতি মায়ের মনে উঁকি দিয়েছে একে একে, “তোমার বাবার সঙ্গে তোমার বিচিত্র স্বভাবের কথা নিয়ে আলাপ করতাম। বলতাম, তোমার ছেলেটা সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরে? তোমার বাবা বলত, জানো প্রমথনাথ বিশীও এমন করে ঘুরে বেড়াত, বিখ্যাত একজন লেখক। তোমার ছেলে নিশ্চয় বিখ্যাত লেখক হবে।”
সন্তানের মৃত্যুর পরও মা চেয়েছিলেন সন্তানের কাছাকাছি থাকতে। তাই কল্পনা করেছিলেন তার আদরের সন্তান হুমায়ূনের কবরটা কেমন হতে পারে, “সম্রাট হুমায়ূনের কবর কেমন হবে সেটা কল্পনা করার ক্ষমতা আমার নাই। কিন্তু আমার হুমায়ূনের সমাধিটা কেমন হবে সেরকম একটা কল্পনা আমার ছিল। সমান মাটির মাঝে কবরটা একটুখানি উঁচু আর পুরো জায়গাটা সবুজ ঘাস দিয়ে গালিচার মতো ঢাকা। আমি কাছে বসে কবরটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে বসে থাকতাম আর বলতাম, আমার বাবাটা ঘুমিয়ে আছে। আমার আদরের মানিক শান্ত হয়ে শুয়ে আছে।”
হুমায়ূন মারা যাওয়ার পরও মা আয়েশা মনে মনে সেটা মেনে নিতে পারেননি। তার মনে হয়েছে তার ছেলে তার আঁচলের ছায়াতলেই আছে। তিনি লিখেন, “তোমার শেষ কবিতায় তুমি লিখেছিলে লিলুয়া হাওয়া নাচে, কবিতার শেষ লাইনটা লেখার জন্য কাগজ নেই, তুমি ছটফট করছ। আমি আমার সাদা শাড়ির আঁচলটা বিছায়ে দিলাম, তুমি সেখানে লিখে রাখলে।”
সন্তান ছাড়া মায়ের বেঁচে থাকার যে কষ্ট এ বইয়ের প্রত্যেকটা পাতায় সেই বিষাদের ছায়া আছে। বইটা শেষ করা হয়েছে এভাবে, “এখন আমি লিখতে বসেছি। লিখে যাচ্ছি, শুধু তোমাকে লিখে যাচ্ছি। আহা রে! যদি এটা সত্যি হতো আসলেই তোমাকে আমি লিখতে পারতাম, তাহলে এই পৃথিবীতে আমার তো এর চাইতে বড় কিছু চাওয়ার ছিলো না। আহা! কেন এটা সত্যি হয় না?”
‘শেষ চিঠি’র শেষ লাইনটা পড়লে নিজের অজান্তেই চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে। একটা লাইন দিয়ে সন্তানহারা মায়ের দুঃখের বোঝা কত ভারি সেটা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, “বেঁচে থাকা বড় কষ্ট বাবা। বড় কষ্ট।”