আমাদের প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিবেচনায় পতিসর রবীন্দ্রকাছারিবাড়ি রক্ষা ও সংরক্ষণের দাবিটা ছিল অনেক আগের। স্বাধীনতাপরবর্তী ১৯৭৪ সালে তৎকালীন নওগাঁর গভর্নর জননেতা আবদুল জলিল ও সে সময়ের এক মন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর আদেশে পতিসরে আসেন। আত্রাই থেকে পতিসর পর্যন্ত টেলিফোন লাইন স্থাপনও করা হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর পতিসর নিয়ে নানা কর্মকাণ্ড থেমে যায়। পরে নব্বইয়ের দশকে পতিসরে রবীন্দ্রনাথের কাছারিবাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর অধিগ্রহণ করে। ১৯৯১ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কাছারিবাড়ি অধিগ্রহণের পর কেবল এটি মেজেঘষে সাদা রং করে একজন তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। কাছারিবাড়ির মধ্যে পড়ে ছিল রবীন্দ্রযুগের একটি ভাঙা চেয়ার ও লোহার একটি সিন্দুক।
বাড়িতে মাঝেমধ্যে চলত সভা-সেমিনার, রাতে নাটকের মহড়া। এভাবেই কেটে যায় দীর্ঘ সময়। আমার ইচ্ছা ছিল রবীন্দ্রনাথের হারানো সব স্মৃতি উদ্ধার করে একটি জাদুঘর করা, কিন্তু বিষয়টি ছিল বড়ই জটিল। রবীন্দ্রস্মৃতি উদ্ধারের জন্য প্রয়োজন ধৈর্য, গবেষণা, অর্থ ও আন্তরিকতা। ধৈর্য ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজটি শুরু করেছিলাম। জমিদারি প্রথা বাতিল ও পরবর্তী পতিসর কাছারিবাড়ি থেকে হারিয়ে যাওয়া রবীন্দ্রস্মৃতির স্থান-কাল-পাত্র-অবস্থান নিশ্চিতকরণ অনেকটা জটিল, কারণ সময়ের পরিবর্তনে সবকিছুর আমূল পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।
আমার দীর্ঘ তালিকার সূত্র ধরে খুঁজতে গিয়ে দেখেছি, রবীন্দ্রনাথের কাছারিবাড়িতে যেসব ব্যক্তি চাকরি করতেন, তাঁরা অনেক আগেই মারা গেছেন। ছেলে-মেয়ে, নাতি-পুতি যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। কার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করব রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত কোনো কিছু আপনার কাছে আছে কি না? তাতে যদি লাঠি হাতে তেড়ে আসে, বলার কিছুই থাকবে না। কেননা, পার হয়ে গেছে অনেক সময়। সবকিছুই জটিল!
হোক জটিল, তা করতে হবে। কেননা, যে রবীন্দ্রনিদর্শনের সন্ধান পেয়েছি, তা নিশ্চিহ্নের পথে। রবীন্দ্রস্মৃতি সংগ্রহের প্রত্যয় নিয়ে বহু অলিগলি, মাঠঘাট, শহর-বন্দর মাড়িয়ে সঠিক অবস্থান নিশ্চিত করে তা উদ্ধার করতে আমার সময় লেগেছে ছয় বছর। বিপুল পরিমাণ রবীন্দ্রস্মৃতি সংগ্রহের পর রবীন্দ্রজাদুঘে ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করার লক্ষ্যে আমি শান্তিনিকেতনে যাই। সেখান থেকে পতিসর, নাগর নদ ও চলনবিলভিত্তিক কিছু ছবি ও জাদুঘরের প্রাথমিক ধারণা নিয়ে ফিরে আসি।
এরপর স্থানীয়ভাবেই শুরু করলাম ছবি প্রিন্ট করা ও জাদুঘরের দেয়ালে সাঁটানো। বিভিন্ন গ্রাম থেকে আমার খুঁজে পাওয়া কবির ব্যবহৃত নাগোর বোটের খাট, নাগোর বোটের আয়না, কাঠের আলমারি, লোহার সিন্দুক, দেয়ালঘড়ি, টি-পট ও ওয়ার্ডরোব, ইজিচেয়ার (আরামকেদারা), কবির লেখা চিঠি, কৃষি ব্যাংকের হিসাবের খাতাসহ সমমানের আরও কিছু রবীন্দ্রনিদর্শন শ্রেণি মোতাবেক কাছারিবাড়িতে আনা। এরপর মূল কাজটা শুরু হয় ২০০৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথের লেখা ছয় পৃষ্ঠার মূল্যবান চিঠি হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে।
তৎকালীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) আবদুল খালেক আমার কাছ থেকে চিঠিটি গ্রহণ করেন। ওই দিন তিনি কথা দিয়েছিলেন, পতিসরে পূর্ণাঙ্গ জাদুঘর করবেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আজ পর্যন্ত হয়নি। ওই বছরের ৮ মে (২৫ বৈশাখ) রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত কৃষি ব্যাংকের দুর্লভ খাতাটির নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তৎকালীন নওগাঁর জেলা প্রশাসক আহসান হাবীব তালুকদারের কাছে হস্তান্তর করেছিলাম। বর্তমানে মূল্যবান এ সম্পদ ন্যাশনাল আর্কাইভে রক্ষিত আছে। এ স্মৃতিচিহ্ন হস্তান্তরের পর পতিসরে নতুন করে আসে পড়ার টেবিলে। উদ্ধার রবীন্দ্রস্মৃতির কথা বিবেচনা করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর নতুন করে কিছু ছবি সংযোজন ও পরপর তিনটা মাস্টাররোল শ্রমিক নিয়োগ করে। এর বাইরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর যা করেছে, তা একটি গণশৌচাগার নির্মাণ। সহকারী কাস্টডিয়ান নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও এ পর্যন্ত দিতে পারেনি।
কিন্তু আমাদের দাবি ছিল পতিসরে পূর্ণাঙ্গ রবীন্দ্রজাদুঘর করা এবং আমার কষ্টার্জিত সব রবীন্দ্রস্মৃতি পতিসরে যথাযথ সংরক্ষণের, কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এ পর্যন্ত কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করেছে বলে আমার মনে হয় না। কেননা, ছয় পৃষ্ঠার চিঠি ও মূল্যবান কৃষি ব্যাংকের খাতার ফটোকপি ঝোলানো আছে পতিসর মিউজিয়ামে, কবির ব্যবহৃত মূল্যবান খাট, আরামকেদারাসহ সমমানের আরও কিছু নিদর্শন প্রয়োজনীয় রাসায়নিক পরীক্ষা হয়েছে বলে মনে হয় না।
আরামকেদারার কারুকাজ নষ্ট হয়ে গেছে, লোহার সিন্দুকে মরিচা ধরেছে। মিউজিয়ামে নেই কোনো কর্মকর্তা। মহামূল্যবান এসব রবীন্দ্রস্মৃতি পুরোটাই ছেড়ে দেওয়া আছে শ্রমিকদের হাতে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ভেবে দেখা দরকার শ্রমিকদের প্রাচীন নিদর্শন বা প্রত্নসম্পদ সম্পর্কে কতটুকু ধারণা আছে! আর অব্যবস্থাপনার কারণে যদি মূল্যবান নিদর্শনের ক্ষতি হয়, এর দায় ভার বহন করবে কে?
রবীন্দ্রস্মৃতি উদ্ধার, সংরক্ষণ, অব্যবস্থপনা নিয়ে লেখালেখি, হইচই কম হয়নি। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে কিছু জাতীয় দৈনিক কাগজে প্রত্যাশিত কিছু পত্রিকার শিরোনাম ছিল চোখে পড়ার মতো, যেমন ‘পোকায় কাটছে রবীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবীর চিঠি’ (সংবাদ, ২৫.৩.২০১১), ‘পতিসর কৃষি ব্যাংক ও রবীন্দ্রসংগ্রহশালা’ (সমকাল, ২৪.১১.২০০৯ আহম্মদ রফিক), ‘সার্ধশতবর্ষে রবীন্দ্রশ্রদ্ধার নমুনা, পোকায় কাটছে রবীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবীর চিঠি’ (আমাদের সময়, ২৫.৪.২০১১), ‘পতিসরে অবৈধ দখলদারির অবসান ঘটাতে হবে’ (কালের কণ্ঠ, ১৯.১.২০১২, আহম্মদ রফিক), ‘রবিঠাকুরের বাড়ি ঘিরে বাজার’ (প্রথম আলো, ১৫.১.২০১২), ‘পতিসরে রবীন্দ্রস্মৃতি উদ্ধার ও সংরক্ষণ জরুরি’ (করতোয়া, ৯.৫.২০১৪, এম মতিউর রহমান মামুন)। সহযোগী সব পত্রিকায় এরূপ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।
প্রতিবেদনগুলোর একটি মাত্র সুর ছিল রবীন্দ্রস্মৃতি উদ্ধার। দাবি ছিল সংরক্ষণের। বিষয়গুলো কর্তৃপক্ষের নজরে পড়েছে বলে মনে হয় না। তবে আশার কথা, এর আগে প্রথম আলোসহ কিছু বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত পতিসর কৃষি ব্যাংকের শত বছরের পুরোনো খাতাটি নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন সাবেক সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তা নিয়ে জরুরি সভা করে খাতাটি ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।
এ বিষয়ে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তৎকালীন নওগাঁর জেলা প্রশাসকের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে, জেলা প্রশাসক মো. এনামুল জানান, অজান্তেই ৪৬ পৃষ্ঠার দুর্লভ লেজার খাতাটি নওগাঁ জেলা প্রশাসকের ট্রেজারি সিন্দুকে সংরক্ষিত ছিল। বিষয়টি জানার পর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সভাপতিত্বে ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, খাতাটি জাতীয় আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তরে সংরক্ষণ করা হবে। ওই সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০১৪ সালের ১১ মে ফ্যাক্সের মাধ্যমে নওগাঁ জেলা প্রশাসক বরাবরে একটি ডিও লেটার পাঠান জাতীয় আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তরের পরিচালক মো. ওদুদুল বারী। এরপর সমবায় অধিদপ্তরের প্রতিনিধিদল নওগাঁ এলে তাদের কাছে খাতাটি হস্তান্তর করা হয়। মূল্যবান খাতাটি ঢাকায় সংরক্ষণ করা হোক, তাতে আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু হস্তান্তরের আগে আমাকে জানানো উচিত ছিল।
২০০৯ সালে আমি খাতাটি জমা দিয়েছিলাম নওগাঁর জেলা প্রশাসকের নিরাপদ হেফাজতে। এই সম্পদ পতিসরের বাইরে যাওয়ার কারণ যতটা জানা গেছে, পতিসরের মিউজিয়াম সুরক্ষিত নয়। পাঠককে জানিয়ে রাখা দরকার, ১৯৩৭ সালের ২৭ জুলাই অসুস্থ কবির স্বাক্ষরিত আশীর্বাণী, কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর মহামূল্যবান চিঠিগুলো পোকায় কাটার সংবাদ প্রকাশিত হলে ও কর্তৃপক্ষ ছুটে আসেনি।
রবীন্দ্রনাথ ১৯০৫ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছু বই এনে পতিসরে তাঁর নিকট আত্মীয়র নামে লাইব্রেরি করেছিলেন, তা-ও অযত্নে ছিল। নিরুপায় হয়ে এই সম্পদ রক্ষা এবং গবেষকদের পাঠে সহায়তার জন্য ২০১৩ সালের ৮ মে কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশনে ‘রবীন্দ্র সংগ্রহশালা’ করেছি। এর কারণে মূল্যবান চিঠিগুলো রাসায়নিক পরীক্ষা ছাড়াই সংরক্ষিত আছে লোহার সিন্দুকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পোকার কবল থেকে রক্ষা পাবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। বিষয়গুলো নিয়ে ২০১৪ সালের ৯ মে বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি তাত্ত্বিক বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক প্রয়াত শামসুজ্জামান খান চ্যানেল আইয়ের (অপ্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ) টক শো অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘এত বিপুলসংখ্যক দুর্লভ রবীন্দ্রস্মৃতি বাংলাদেশে এর আগে কেউ উদ্ধার ও সংরক্ষণ করতে পারেনি।’ মূল্যবান রবীন্দ্রস্মৃতিগুলো যথাযথ সংরক্ষণের জন্য রবীন্দ্রজাদুঘর করার যৌক্তিকতাও তুলে ধরেছেন তিনি। একাডেমির পক্ষ থেকে যথাযথ ভূমিকা গ্রহণের আশা ব্যক্ত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ পতিসরে যে কৃষি ব্যাংক করেছিলেন (১৯০৯ সালে), তা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। এসব স্মৃতি যথাযথ রক্ষা ও উদ্ধারের কল্পে যে তহবিল গঠনের কথা ছিল, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দ্রুত সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
* রবীন্দ্রস্মৃতি সংগ্রাহক ও গবেষক