লেখক: আমিমুল আহসান তানিম
বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম শুধু তাঁর বিপ্লবী চেতনা ও বৈষম্যবিরোধী অবস্থানের জন্যই স্মরণীয় নন, বরং তাঁর হৃদয়ের গভীর সহানুভূতির জন্যও তিনি চিরস্মরণীয়। সমাজের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য কলম ধরলেও নজরুলের ব্যক্তিগত জীবন ছিল বেদনাময় ও সংগ্রামের। তাঁর জীবনের সবচেয়ে করুণ ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ১৯২৯ সালে তাঁর প্রথম সন্তান আরিন্দম খালেদ বুলবুলের অকাল মৃত্যু। এই ঘটনা শুধু তাঁর পিতৃসত্ত্বাকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল না, বরং তাঁর সাহিত্যকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
আনন্দ থেকে বিষাদ:
বুলবুল, যার নাম রাখা হয়েছিল এক সুরেলা পাখির নামে, জন্মেছিলেন এক ভালোবাসায় পরিপূর্ণ, সঙ্গীত-সাহিত্যের আবেশে মোড়ানো ঘরে। নজরুল ও প্রমিলা দেবীর প্রথম সন্তান হিসেবে বুলবুল ছিলেন তাদের ভালোবাসা ও স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু সে সময়কার ভয়ানক রোগ বসন্তে আক্রান্ত হয়ে মাত্র চার বছর বয়সেই বুলবুলের মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর সময় নজরুলের দ্বিতীয় পুত্র সাব্যসাচীর জন্ম হয়েছিল মাত্র পাঁচ মাস আগে।
এই মৃত্যু নজরুলকে ভীষণভাবে ভেঙে দিয়েছিল। পিতা হিসেবে যে সন্তানের মধ্যে তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাকে এত তাড়াতাড়ি হারানো ছিল এক গভীর মানসিক আঘাত।
দাফনের খরচ ব্যয় জন্য তৎক্ষণাত লেখা :
এই বেদনাদায়ক ঘটনার সময় নজরুল চরম আর্থিক সংকটে ছিলেন। স্বনামধন্য কবি হয়েও তাঁর জীবন ছিল আর্থিক দিক থেকে অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ। সন্তানের শেষকৃত্যের খরচ জোগাড় করতেও তিনি হিমশিম খাচ্ছিলেন।
এই চরম দুঃসময়ে, পিতৃত্বের যন্ত্রণাকে কলমে ঢেলে দিয়ে, নজরুল একটি শোকগাথা লিখেছিলেন — সঙ্গে সঙ্গে, শুধুমাত্র একটি সংবাদপত্রের সম্পাদকের অনুরোধে — যেন সেই অর্থ দিয়ে বুলবুলের দাফন কার্য সম্পন্ন করা যায়। এটি ছিল এমন এক মুহূর্ত, যেখানে একজন পিতা তাঁর সন্তানের মৃত্যুশোককে বিক্রি করতে বাধ্য হন, শুধুমাত্র তার অন্তিম সৎকারের ব্যবস্থা করতে।
শোকের প্রতিধ্বনি কবিতায়
বুলবুলের মৃত্যুর পর নজরুলের কবিতায় এক নতুন আবেগের প্রবাহ শুরু হয়। যাঁর কলম এতদিন ছিল বিদ্রোহের অগ্নিশিখা, তাঁর ভাষায় এবার ছায়া পড়ে বিষাদের। তাঁর বহু কবিতায় দেখা যায় জীবনের অনিত্যতা, স্মৃতির ব্যথা, আর হারানোর গহীন আর্তি।
তিনি লিখেছিলেন:
“বুলবুল আমার, চির নেই তুমি,
সে যে আলো ছিল, ছিল ভোরের ঝিলমিল—
সে তো গেল মিটিয়ে, বিদায় হলো নির্ঝর…”
এই পংক্তিগুলো যেন একজন শোকাহত পিতার হাহাকার — শিশুর সেই হাসি, সেই কণ্ঠস্বর, সেই স্পন্দন আজ নেই, আর কখনও আসবে না।