বাংলাদেশ

জাতিসংঘ সফর শেষে কী নিয়ে ফিরলেন ড. ইউনূস

12036_IMG_1953.jpeg

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বর্তমান বিশ্বের অন্যতম আলোচিত মানুষ। তিনি থ্রি জিরো থিওরি উদ্ভাবক এবং বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মানে সরকার প্রধান।ড. ইউনূসের বিশ্বব্যাপী পরিচিতি ও সম্মানের কারণে তাঁর কাছে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশাও একটু বেশি।তিনি এবছর জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ সভায় ভাষণ দিয়েছেন। জাতিসংঘের সাইড লাইনে বিভিন্ন দেশের প্রধানদের সঙ্গে কয়েক ডজন বৈঠক করেছেন।সর্বশেষ ৩০ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গাদের নিয়ে জাতিসংঘের আয়োজনে কনফারেন্সে যোগদানের মধ্য দিয়ে তার সফরের ইতি টানেন। তিনি ৩০ সেপ্টেম্বর রাত ১১টায় স্থানীয় সময় নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশের উদ্যোশে রওয়ানা দিয়েছেন।ড. ইউনূস এবারের জাতিসংঘের অধিবেশনে এসে কী অর্জন করলেন তা জানার জন্য বাংলাদেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।

সরকারের প্রেস উইংয়ের পক্ষ থেকে যা সরবরাহ করা হয়েছে মোটাদাগে সংবাদমাধ্যমগুলো সেটিই প্রকাশ করেছে। কারণ সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিনিধিদের সাইড লাইনের বৈঠকগুলোতে সরাসরি উপস্থিত থাকার অনুমতি ছিলো না।

তবে বৈঠকগুলোতে কোনো অর্জন থাকলে তিনি দেশে ফিরে অবশ্য জাতিকে বিস্তারিত জানাবেন। আবার যদি কিছু অর্জন থাকে যেটি রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার অংশ সেটি সম্পর্কে জানানো নাও হতে পারে।

তবে এখন পর্যন্ত মোটাদাগে দুটি অর্জন জাতির সামনে এসেছে। একটি হলো জাতিসংঘ সদর দপ্তরে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনে রোহিঙ্গাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য ৯৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

এই প্রথমবারের মতো ৭৫টি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে রাজনৈতিক সমর্থন অর্জন, আন্তর্জাতিক মনোযোগ ধরে রাখা, পরিস্থিতির সামগ্রিক মূল্যায়ন এবং মানবাধিকারসহ সংকটের মূল কারণগুলো আলোচনা হয়েছে। যেটি রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

প্নধান উপদেষ্টা সম্মেলনে সাতটি দাবি তুলে ধরলে অধিকাংশ দেশ তাকে সমর্থন জানান।

দাবিগুলো হলো-

প্রথমত: নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য একটি বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ প্রণয়ন, যা রাখাইনে যথাযথ স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।

দ্বিতীয়ত: মিয়ানমার ও আরাকান আর্মির ওপর কার্যকর চাপ প্রয়োগ করে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করা এবং টেকসই প্রত্যাবাসন শুরু করা—প্রথমে বাংলাদেশে সদ্য আগত ও মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতদের ফিরিয়ে দেওয়া।

তৃতীয়ত: রাখাইনের স্থিতিশীলতার জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা জোগাড় করা এবং সেখানে আন্তর্জাতিক বেসামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা।

চতুর্থত: রাখাইন সমাজ ও প্রশাসনে রোহিঙ্গাদের টেকসই একীভূতকরণের জন্য আস্থা গড়ে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ।

পঞ্চমত: যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনা (Joint Response Plan) পূর্ণ অর্থায়নে দাতাদের সহায়তা নিশ্চিত করা।

ষষ্ঠত: দায়বদ্ধতা ও পুনর্ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।

সপ্তমত: মাদক অর্থনীতি ধ্বংস করা এবং সীমান্ত-পারাপার অপরাধ দমন করা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, যেহেতু প্রায় সব দেশই ড. ইউনূসের দাবিকে যৌক্তিক মনে করেছেন সেক্ষেত্রে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে লেগে থাকতে হবে।

প্রধান উপদেষ্টা কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে মিটিংয়ে ব্যবসা বাণিজ্যের সম্পসারণের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েছেন। দেশগুলোর সঙ্গে বৈঠকের প্রতিশ্রুতির ধারাবাহকতা বজায় থাকলে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ অনেক লাভবান হবে।

বিশেষ করে ইতালির সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক বাড়ার সম্বাবনা অনেক বেশি।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে অনুরোধ করলে ইতালির প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ-ইতালি বাণিজ্য সম্পর্কের উন্নয়নে ইতালি বাংলাদেশ বিজনেস ফোরাম গঠনের প্রস্তাব দেন।

ইতালির প্রধানমন্ত্রী তার দেশ জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ৩০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত রোহিঙ্গা বিষয়ক সম্মেলনে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছে।

এমনকি ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি আশা প্রকাশ করেছেন যে তিনি আগামী ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সফর করবেন।

উল্লখ্য, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য ইত্যাদি ইতালিতে রপ্তানি হয় এবং ইতালি বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার।

দেশের চুরি হয়ে যাওয়া কয়েক বিলিয়ন ডলার সম্পদ পুনরুদ্ধারের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সভাপতি অজয় বাঙ্গার সহযোগিতা কামনা করলে তিনি উদ্যোগ নিবেন বলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জানিয়েছেন।

প্রধান উপদেষ্টা জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, জলবায়ু সংকট চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় বিশ্বজনীন তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যমাত্রা আজ আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু সহায়তার প্রতিশ্রুতিও পূরণ হয়নি। বরং যে ক্ষুদ্র অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ হয়ে থাকে, তাও কাগজে কলমে দেখানো হচ্ছে বহুগুণ হিসেবে। এটি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।

প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশি অভিবাসীদের অধিকারের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, শ্রম অধিকার সংস্কার এগিয়ে নিচ্ছি। ইতোমধ্যেই স্বাধীন শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে একটি কমিটি গঠিত হয়েছে; বাংলাদেশ শ্রম আইন সংশোধনের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে, যেখানে ট্রেড ইউনিয়ন প্রক্রিয়া সহজ করা, মাতৃত্বকালীন ছুটি বৃদ্ধি, এবং আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয় খাতের শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা সম্প্রসারণের পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়নের জন্য অনলাইন নিবন্ধন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে এবং নিবন্ধন প্রক্রিয়াকে আরও সহজতর করার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি, শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় আমাদের অঙ্গীকারের নিদর্শনস্বরূপ সম্প্রতি আমরা ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার লেবার সেন্টারের সংবিধিতেও স্বাক্ষর করেছি।

এই কারণেই আমরা নিরাপদ, সুশৃঙ্খল ও নিয়মিত অভিবাসনকে সমর্থন করি এবং যেসব দেশে প্রবাসী শ্রমিকরা যান সেই সব দেশে তাঁদের জন্য সহমর্মিতা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান জানাই।

এ তহবিল সঠিকভাবে প্রদান ও বন্টন হলে বাংলাদেশ উপকৃত হবে।

এছাড়া ড. ইউনূস বৈশ্বিক নানা বিষয় বিশেষ করে ফিলিস্তিনকে সমর্থন করে বক্তব্য দিয়েছেন।

তবে প্রধান উপদেষ্টার এ বছরের সফর ঘিরে রাজনৈতিক মাঠ ছিলো চরম উত্তপ্ত। বিমানবন্দরে জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে অপমান, রাজনীবিদদের ভূমিকা এবং আগামী নির্বাচনের বিষয়টি উঠে এসেছে। বিএনপি জানিয়েছে, ড. ইউনূসের ওপর তারা খুশি এবং ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ব্যাপারে তারা আশাবাদী। কেউ কেউ মনে করছেন বিএনপি জাতিসংঘে ড. ইউনূসের সঙ্গে জাতিসংঘে আসায় তাদের ক্ষতি হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা তাঁর স্বার্থ উদ্ধার করেছেন।

তবে কেউ কেউ মনে করছেন, ইউনূস নির্বাচন না দিয়ে আরও কয়েকবছর ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করছেন। রাজনীতিবিদদের নিয়ে বিশ্বকে দেখিয়েছেন যে বাংলাদেশের জনপ্রিয় ও ক্ষমতাধররা তাঁর সঙ্গে আছেন। সে কারণে তিনি প্রায় সব বৈঠকেই বিশ্ব নেতাদের সহযোগিতা কামনা করেছেন। বিশ্ব নেতারাও তাঁকে আকুণ্ঠ সমর্থন দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লষক অধ্যাপক জোবাইদা নাসরিন বলেন, ৯৬ মিলিয়ন ডলারের সহযোগিতা ইতিবাচক। তবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন জরুরি।

‘জাতিসংঘের সফরে ড. ইউনূস কী অর্জন করেছেন তা নিশ্চয়ই তিনি জাতিকে জানাবেন। তবে কোনো প্রতিশ্রুতিই কাজে আসবে না যদি যথাযথভাবে যোগাযোগ, লবিং করা না হয়।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. কাজী মাহবুবুর রহমান বলেন, ইউনূসের এবারের সফরে অনেক সাইডলাইন মিটিং হয়েছে। তবে প্রতিশ্রুতি অর্জন নির্ভর করবে সরকারের উপর। সরকারকে নিয়মিত লবিং তদবির করতে হবে। অন্যথায় কোন প্রতিশ্রুতি কাজে আসবে না।

তিনি বলেন, এবারের সফরে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা বেড়েছে। আওয়ামী লীগের বাড়াবাড়ির কারণে দেশে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।

তবে সবকিছু মিলিয়ে জাতিসংঘের সফর এর থেকে বিগত কোনো বছরই অনেক অর্জনের বিষয় ছিলো না। ড. ইউনূস বিশ্ব নাগরিক হওয়ায় বিদেশ থেকে অনেক কিছু আদায় করে নেওয়া তাঁর পক্ষে সহজ হবে। আমরা খুবই আশাবাদী।

সর্বাধিক পঠিত


ভিডিও