বিশ্ববিখ্যাত ওষুধ ও প্রসাধনী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জনসন অ্যান্ড জনসনের (J&J) বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যে একটি বড় ধরনের মামলা দায়ের হয়েছে। প্রায় তিন হাজার ভুক্তভোগী কোম্পানিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, প্রতিষ্ঠানটি বহু বছর ধরে অ্যাসবেস্টস দ্বারা দূষিত ট্যালকম পাউডার বিক্রি করে মানুষকে ক্যান্সারের ঝুঁকিতে ফেলেছে। মামলাটি দায়ের করেছে আইন সংস্থা কেপি ল (KP Law)। বিবিসির হাতে থাকা অভ্যন্তরীণ নথি ও বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বলা হয়েছে, ১৯৬০-এর দশক থেকেই জনসন অ্যান্ড জনসন জানত তাদের বেবি পাউডারে ট্রেমোলাইট ও অ্যাকটিনোলাইট নামের খনিজ উপাদান রয়েছে, যেগুলোর তন্তুযুক্ত রূপকে অ্যাসবেস্টস হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয় এবং ক্যান্সারের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।
অভিযোগে বলা হয়েছে, ঝুঁকির বিষয়টি জানার পরও কোম্পানিটি কোনো সতর্কতামূলক তথ্য পণ্যের গায়ে উল্লেখ করেনি। বরং ‘পরিষ্কার ও নিরাপদ’ পণ্যের প্রতিচ্ছবি তৈরি করতে তারা বছরের পর বছর ব্যাপক বিপণন প্রচারণা চালিয়েছে। তবে জনসন অ্যান্ড জনসন এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কোম্পানির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তাদের বেবি পাউডার সবসময় নিয়ন্ত্রক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, এতে অ্যাসবেস্টস ছিল না এবং এটি ক্যান্সার সৃষ্টি করে না। যুক্তরাজ্যে ট্যালকম পাউডার বিক্রি বন্ধ করা হয় ২০২৩ সালে, এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০ সালেই এই পণ্য বাজার থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
এই মামলা যুক্তরাষ্ট্রে চলমান একাধিক মামলার প্রতিফলন, যেখানে আদালত ইতোমধ্যে বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে জনসন অ্যান্ড জনসন রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে। যুক্তরাজ্যে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ শত শত মিলিয়ন পাউন্ডে পৌঁছাতে পারে, যা দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পণ্য দায়বদ্ধতা মামলা হয়ে উঠতে পারে বলে আইনজীবীরা মনে করছেন।
বিবিসির হাতে থাকা ১৯৭০-এর দশকের এক নথিতে দেখা যায়, কোম্পানির অভ্যন্তরীণ আলোচনায় তারা অ্যাসবেস্টস অপসারণের একটি সম্ভাব্য পদ্ধতি নিয়ে পেটেন্ট নেয়ার চিন্তা করেছিল। কিন্তু এক চিঠিতে লেখা ছিল, “আমরা হয়তো বিষয়টি গোপন রাখতে চাইবো, যেন পুরো বিশ্ব জানতে না পারে।” কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পেটেন্টটি কার্যকর প্রমাণিত না হওয়ায় এটি বাস্তবায়ন করা হয়নি।
মামলার নথিতে আরও বলা হয়েছে, ১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে মার্কিন বাজারে শিশুদের জন্য ‘বিশুদ্ধ ও কোমল’ পাউডার হিসেবে প্রচারণা চালানো হয়। পরবর্তীতে ১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকে বিজ্ঞাপনের লক্ষ্যবস্তুতে ছিল আফ্রিকান-আমেরিকান নারীরা। ২০০৮ সালের একটি অভ্যন্তরীণ ইমেইলে বলা হয়েছিল, “বাস্তবতা হলো, ট্যালক শিশুর জন্য নিরাপদ নয়—এটি উদ্বেগজনক।” তবে কোম্পানির দাবি, ওই মন্তব্য শ্বাসরোধজনিত ঝুঁকির প্রসঙ্গে ছিল, ক্যান্সার নয়।
মামলার অনেক বাদীই ডিম্বাশয় ক্যান্সার ও মেসোথেলিওমায় আক্রান্ত, যা সাধারণত অ্যাসবেস্টস-জনিত ক্যান্সার হিসেবে পরিচিত। তাদের বেশিরভাগই দীর্ঘদিন জনসন অ্যান্ড জনসনের বেবি পাউডার ব্যবহার করেছেন। ৬৩ বছর বয়সী সিওভান রায়ান বিবিসিকে বলেন, “আমার মা এটি ব্যবহার করতেন, আমিও করেছি। মনে হতো এটি নিরাপদ ও কোমল। কিন্তু এখন আমি স্টেজ-৪ ডিম্বাশয় ক্যান্সারে আক্রান্ত। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে তারা সব জানত, তবু আমাদের বিক্রি করেছে।”
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট অঙ্গরাজ্যের এক আদালত জনসন অ্যান্ড জনসনকে ২৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে আদেশ দিয়েছে। আদালতের রায়ে বলা হয়, কোম্পানিটি সচেতনভাবেই অ্যাসবেস্টসযুক্ত ট্যালক বিক্রি করেছে। কোম্পানির প্রাক্তন টক্সিকোলজি পরিচালক ড. স্টিভ ম্যান আদালতে স্বীকার করেছেন যে তিনি পরীক্ষার ফলাফল না দেখেই নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিবৃতি দিয়েছিলেন এবং অ্যাসবেস্টসের উপস্থিতির তথ্য গোপন করেছিলেন।
বিচারক উল্লেখ করেন, কোম্পানির কাছে কর্নস্টার্চ-ভিত্তিক নিরাপদ বিকল্প ছিল, তবুও তারা তা ব্যবহার করেনি। বর্তমানে জনসন অ্যান্ড জনসনের ভোক্তা পণ্য বিভাগ কেনভিউ (Kenvue) নামে আলাদা কোম্পানি হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। কেনভিউ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা ক্যান্সারে আক্রান্তদের প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করছে, তবে তাদের পণ্যের নিরাপত্তা বহু স্বাধীন গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে।
Source: BBC