ব্যবসায় ভারতের প্রথম সারির অংশীদার বাংলাদেশ
ভৌগোলিক অবস্থান বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ। এই অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ এতদঞ্চলের ‘ট্রান্সপোর্ট হাব’ (পরিবহনের কেন্দ্র) হয়ে উঠছে। আর এ অঞ্চলের অর্থনীতির ‘গেম চেঞ্জার’ হতে চলেছে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর। মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটির মাধ্যমে অর্থাৎ সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গেটওয়ে হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উচ্চহার হতে পারে আরও টেকসই।
রোববার (২৯ আগস্ট) ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি বিষয়ক সাংবাদিকদের নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা এ কথা বলেন। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নয়নের অবারিত সুযোগ বিষয়ে এ সেমিনারের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী। বাণিজ্য, যোগাযোগ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে উপস্থাপনায় ছিলেন হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব (বাণিজ্যিক) প্রমেশ বসাল, রেলওয়ে উপদেষ্টা আনিতা বারিক, এক্সিম ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার আবাসিক প্রতিনিধি প্রিয়াংশু তিওয়ারি। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন হাইকমিশনের প্রথম সচিব (তথ্য, সংস্কৃতি ও গণমাধ্যম) শাশ্বতী আর্যা।
১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশকে অন্যতম ‘বৃহৎ অর্থনীতি’ উল্লেখ করে হাইকমিশনার দোরাইস্বামী বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। এ দেশ হচ্ছে ভারতের প্রথম সারির ব্যবসায়িক অংশীদার। আমাদের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগীও বাংলাদেশ। এই জায়গাটিকে আরও এগিয়ে নিতে কাজ করছে ভারত সরকার।
তিনি বলেন, ভৌগোলিক কারণে এই অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নেপাল, ভুটান এবং ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর কাছে। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক অর্থনীতির ‘গেম চেঞ্জার’ (মূল প্রভাবক) হতে চলেছে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর। বিশেষ করে ত্রিপুরা, মিজোরাম, অরুণাচলের অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বন্দর দুটি। এমনকি মিয়ানমারও বন্দর দুটির সুবিধা নিতে পারে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ছাড়া নেপাল ও ভুটানের উন্নয়নও সম্ভব নয়।
প্রমেশ বসাল তার ‘বাংলাদেশ ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও যোগাযোগ: ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি ও যৌথ সমৃদ্ধি’ শীর্ষক উপস্থাপনায় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বাণিজ্য ঘাটতি, ট্যারিফ ও নন-ট্যারিফ প্রতিবন্ধকতা, যোগাযোগ ও এর সুবিধা, ট্রানজিটে বাণিজ্য সুবিধা, বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ এবং রেমিট্যান্স বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) বরাত দিয়ে তিনি জানান, বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানি ক্রমেই বাড়ছে। ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানিও বাড়ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে যেখানে বাংলাদেশ ভারতে ৬৮৯ মিলিয়ন ডলার রফতানি করেছিল, ২০২০-২১ অর্থবছরে সেটা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ২৭৯ মিলিয়ন ডলারে। অন্যদিকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারত থেকে যেখানে আমদানি করেছিল পাঁচ হাজার ৪৫২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, সেখানে ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমদানি করেছে পাঁচ হাজার ৭৯৩ মিলিয়ন ডলারের পণ্য।
ইপিবির বরাতে তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ ২০২০-২১ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি রফতানি করেছে ভারতেই। তাদের পর বাংলাদেশের রফতানির তালিকায় আছে যথাক্রমে জাপান, চীন, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব। এরপরে আছে ভারত ছাড়া সার্কভুক্ত অন্য দেশগুলো।
বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে প্রমেশ বসাল জানান, দু’পক্ষ মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করলে ভারতে বাংলাদেশের রফতানি ১৮২ শতাংশ এবং বাংলাদেশে ভারতের রফতানি ১২৬ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। আর যদি পরিবহন যোগাযোগের (ট্রান্সপোর্ট কানেক্টিভিটি) উন্নয়ন করা হয় তাহলে ভারতে বাংলাদেশের রফতানি বেড়ে যেতে পারে ২৯৭ শতাংশ এবং বাংলাদেশে ভারতের রফতানি বেড়ে যেতে পারে ১৭২ শতাংশ। নির্বিঘ্ন পরিবহন যোগাযোগ ব্যবস্থা বাংলাদেশের জাতীয় আয় বাড়িয়ে দিতে পারে ১৭ শতাংশ এবং তা ভারতের বাড়িয়ে দিতে পারে ৮ শতাংশ।
চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার বিষয়ক চুক্তির ফলে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে এতদঞ্চলের ট্রান্সপোর্ট হাব। সংশ্লিষ্ট জায়গায় কর্মসংস্থান তৈরি হবে। বাংলাদেশি ট্রাকের ব্যবহার বাড়বে। লজিস্টিকস ও সার্ভিস শিল্পের উন্নয়ন ঘটবে। ফি, কাস্টমস, পোর্ট চার্জ ও রোড ফির মতো রাজস্ব আয় বাড়বে সরকারের। যদিও ফি ও চার্জ এখনো চূড়ান্ত হয়নি, অবশ্য এরই মধ্যে ২০২০ সালের জুলাইয়ে চারটি কনটেইনার পরীক্ষামূলকভাবে চলেছে।
প্রমেশ বসাল তার উপস্থাপনায় ‘মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটি’র সুবিধাও তুলে ধরেন। তিনি জানান, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৩৫৫টি ভারতীয় কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে। মোংলা ও মিরসরাইতে ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল হলে এই বিনিয়োগ আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ থেকে ভারতের রেমিট্যান্স আয়ের বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের ২০১৮ সালের একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে প্রমেশ বসাল জানান, (ওই হিসাবে) বাংলাদেশ থেকে ভারতে রেমিট্যান্স গেছে ১২৬ মিলিয়ন ডলার। বিপরীতে ভারত থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স এসেছে চার হাজার ৩৩ মিলিয়ন ডলার।
প্রিয়াংশু তিওয়ারি তার উপস্থাপনায় উল্লেখ করেন, ভারত সরকারের পক্ষে ঋণ সহায়তায় লাইন অব ক্রেডিট বা এলওসি চুক্তি পরিচালনা করে থাকে এক্সিম ব্যাংক। এখন পর্যন্ত এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, ওশেনিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ৬৫টি দেশে ৩০৯টি এলওসি বাস্তবায়িত হচ্ছে। যে ঋণের মোট অংক ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ভারত সরকারের চারটি এলওসি বাস্তবায়ন হচ্ছে বাংলাদেশে, যার অংক ৭ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার। এটা বৈশ্বিক ঋণের অংকের তুলনায় ২৬ শতাংশ প্রায়।
আনিতা বারিক তার উপস্থাপনায় জানান, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রেলপথে বাণিজ্য বাড়ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যেখানে ১৯ লাখ ৮৫ হাজার ১৬৩ মেট্রিক টন পণ্য পরিবহন করা হয়েছিল, ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ লাখ ৯৩ হাজার ৯৮৬ মেট্রিক টনে। আর এই পণ্য পরিবহনে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ আয় করে ৯৬ কোটি সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে যা দাঁড়িয়েছে ১৭৬ কোটি ৭৪ লাখ টাকারও বেশি।