বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ক্রেতা H&M এর ২০ কোটি ডলারের পণ্যের চালান আটকে গেছে

9488_IMG_6146.jpeg

দেশের তৈরি পোশাক পণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম সুইডিশ কোম্পানি এইচঅ্যান্ডএম। প্রতিষ্ঠানটি বছরে ৩০০ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থমূল্যের পোশাক বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে। কোম্পানিটির ক্রয়াদেশে প্রস্তুত করা ২০ কোটি ডলার মূল্যের চালান এখন চট্টগ্রাম বন্দরে আটকে রয়েছে। এ বিষয়ে এইচঅ্যান্ডএমের বাংলাদেশ অফিস সূত্রে জানা গেছে, ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ হয়ে পড়ায় শতভাগ অনলাইননির্ভর রফতানি প্রক্রিয়া এখন বন্ধ। এর প্রভাবে কোম্পানিটির ক্রয়াদেশে তৈরি করা চালান এখন চট্টগ্রাম বন্দরে আটকে রয়েছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে সংঘর্ষ-সহিংসতা বেড়ে গেলে গত ১৯ জুলাই দেশে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায়। এতে স্বয়ংক্রিয় অ্যাসাইকুডা ব্যবস্থায় রফতানিবিষয়ক নথি বা শিপিং বিলসংশ্লিষ্ট যাবতীয় এন্ট্রি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়ে। থমকে যায় শতভাগ অনলাইন-নির্ভর রফতানি প্রক্রিয়া। জাহাজে ওঠার আগেই আটকা পড়ে এইচঅ্যান্ডএমসহ বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানিকারক অনেক প্রতিষ্ঠানের চালান। যোগাযোগবিচ্ছিন্ন অবস্থায় ক্রয়াদেশ দাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে রফতানি চালান আটকে পড়ার ঘটনা জানানো সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। চালান জাহাজীকরণ করতে না পারায় রফতানি পণ্যবাহী জাহাজের পণ্য না নিয়েই চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে।

এইচঅ্যান্ডএম বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার জিয়াউর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে আমাদের প্রচুর মালামাল পড়ে আছে। শুধু ইন্টারনেট নেই দেখে এগুলো হ্যান্ডওভার করতে পারছি না। কারফিউ থাকলেও যদি ইন্টারনেটটা চালু থাকত তাহলেও হতো। আমাদের অন্তত ২০০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য পড়ে আছে, যেগুলো আমরা কার্গো করতে পারিনি। মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকলেও যদি ব্রডব্যান্ডের ইন্টারনেটটাও থাকত, আমরা কাজটা চালিয়ে নিতে পারতাম। আমরা বায়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না চারদিন ধরে। আমি যে যোগাযোগ করতে পারছি না, সেটাও তাদের জানানো যাচ্ছে না। এ সপ্তাহে আমাদের অর্ডার প্লেসমেন্ট ছিল, যোগাযোগ না হওয়ায় সেগুলো আমরা করতে পারিনি।’

তিনি আরো বলেন, ‘সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারের সিদ্ধান্তকে আমরা শতভাগ শ্রদ্ধা করি। পরিস্থিতি আসলেই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যত দ্রুত সম্ভব ব্যবসা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়া দরকার। তা না হলে আমরা পিছিয়ে যাব।’

বাংলাদেশ থেকে আর যেসব প্রতিষ্ঠান বৃহদায়তনে পোশাক আমদানি করে থাকে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ইন্ডিটেক্স, সিঅ্যান্ডএ, ওয়ালমার্ট, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার, গ্যাপ, পিভিএইচ ইত্যাদি। শিল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, এ ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো কম-বেশি ১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বাংলাদেশ থেকে ক্রয় করে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ছোট-বড় প্রায় সব ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকেই পণ্য আটকে থাকার বিড়ম্বনা মোকাবেলা করতে হচ্ছে।

পোশাক রফতানিকারক সংগঠনের প্রতিনিধিরা বলছেন, বাংলাদেশী পোশাকের বৈশ্বিক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় রফতানি বাণিজ্যে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটছে। ক্রেতাদের সঙ্গে নতুন ক্রয়াদেশ নিয়ে আলোচনাও করা সম্ভব হচ্ছে না।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ক্রেতারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। তাদের কোনো ই-মেইল এলে সেটা আমরা পাচ্ছি না। এ পরিস্থিতিতে আমাদের কিছু ক্রয়াদেশও হারাতে হবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ যে কমিউনিকেশন, পরিবহন বা ট্রান্সপোর্ট যেমন পণ্য আনা-নেয়া, বিশেষ করে অ্যাকসেসরিজ, কাঁচামাল আসা-যাওয়া ইত্যাদিও ব্যাহত হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় আমরা ক্রেতাদের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে পারছি না। পণ্যের চালানগুলো শিপমেন্ট করতে পারছি না, কারণ ইন্টারনেট না থাকায় শিপিং বিলের অ্যাসাইকুডা এন্ট্রির সব কার্যক্রম বন্ধ। কাস্টমস পুরো কলাপ্স করেছে। ফলে আমাদের যেসব পণ্য গেছে বা যাচ্ছে, সেগুলো পড়ে থাকছে। কোনোটাই শিপমেন্ট হচ্ছে না। এমনও ঘটেছে যে চালান বোঝাই যানবাহন গিয়ে ডিপোয় প্রবেশ করতে পারেনি। ডিপোর বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সব। বলা যায় পণ্যের চালান অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। মালামাল বন্দরে গিয়েও শিপমেন্ট হতে পারছে না। ক্রেতাদের আমরা জানাতেও পারছি না যে বিরাজমান পরিস্থিতিতে আমরা জাহাজীকরণ করতে পারিনি। কমিউনিকেশন পুরোপুরি বন্ধ। ফোনে যতটুকু বার্তা দেয়া যাচ্ছে ততটুকুই।’

এইচঅ্যান্ডএমসহ বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি আমদানি করা  কোম্পানিগুলোকে পোশাক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম স্টারলিং গ্রুপ ও লায়লা গ্রুপ। এ দুই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অন্যতম বড় পোশাক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এইচঅ্যান্ডএম। শুধু এ প্রতিষ্ঠান না বাংলাদেশ থেকে ছোট-বড় কারো পণ্যই যাচ্ছে না। আশা করছি আজ (গতকাল) বা কাল (আজ) ব্রডব্যান্ডটা চালু হবে। এ কয়দিনের ঘটনায় ব্যবসায় প্রভাব তো পড়বেই, কিন্তু কিছু করার নেই। তবে সাময়িক এ ঘটনার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে পড়বে না বলে আমি মনে করি।’

পোশাক পণ্য প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ‘গত শনি, রবি ও সোমবার সব কারখানা সার্বিক নিরাপত্তার খাতিরে বন্ধ রাখা হয়। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সব এলাকা শান্ত রয়েছে। শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণ অবস্থায় যার যার বাসস্থানে অবস্থান করছেন। তবে কারখানা বন্ধ থাকায় পোশাক খাতে প্রতিদিন আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।’

বিজিএমইএ সভাপতি এসএম মান্নান (কচি) এ বিষয়ে বলেন, ‘বড় ক্ষতি হচ্ছে এই যে আমাদের প্রতি আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা ও নির্ভরতায় ঘাটতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ফলে আমাদের ভাবমূর্তির যে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে তা টাকার অংকে প্রকাশ করা কঠিন। আমরা আশা করি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সরকারের সব প্রচেষ্টা খুব শিগগিরই সফলতা নিয়ে আসবে এবং আমরা সবাই স্বাভাবিক ব্যবসায়িক জীবনে ফিরে যেতে পারব।’

সর্বাধিক পঠিত


ভিডিও