অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে গতকাল সোমবার কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, আওয়ামী লীগের আমলে দেশকে ‘চামচা পুঁজিবাদ’ থেকে চোরতন্ত্রে পরিণত করা হয়েছে। আইনসভা, নির্বাহী বিভাগসহ সবাই গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে চুরির অংশ হয়ে গেছে। এটাই চোরতন্ত্র। এজন্য রাজনীতিক, ব্যবসায়ী এবং উর্দি পরা কিংবা উর্দি ছাড়া আমলারা সহযোগী ছিলেন। এই চোরতন্ত্রের উৎস ২০১৮ সালের নির্বাচন। গত সাড়ে ১৫ বছরে রাজনীতিবিদদের চেয়ে আমলারা বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন বলে মনে করে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে প্রশাসনের পচন শুরু হয় মূলত ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে। সেই সময় থেকেই আমলাতন্ত্র রাজনীতিতে শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসে। আর ২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনার বিগত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে আমলাতন্ত্র হয়ে ওঠে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র। বিতর্কিত তিনটি নির্বাচনের প্রধান কারিগরও প্রশাসনের আওয়ামীপন্থি আমলারা।
১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের শেষ সময়ে সচিবালয়ে আওয়ামীপন্থি কিছু আমলাকে নিয়ে গঠিত হয় ‘জনতার মঞ্চ’। ওই মঞ্চ গঠনের প্রধান কুশীলব ছিলেন তৎকালীন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) ড. মহীউদ্দীন খান (ম খা) আলমগীর। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তার হাত ধরে প্রশাসনে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির মহোৎসবের সূচনা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে শেখ হাসিনা জনতার মঞ্চ গঠনের পুরস্কার হিসেবে ম খা আলমগীরকে প্রতিমন্ত্রী বানান। এ ছাড়া মঞ্চে যোগদানকারী অন্যান্য কর্মকর্তাকেও বড় বড় দপ্তরে বসিয়েছিলেন হাসিনা। তাদের ‘পুরস্কৃত’ করার পর অন্য আমলারাও একে একে নিজেদের রাজনীতি ও দুর্নীতিতে জড়ান। আর ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচ টি ইমাম (প্রয়াত) প্রশাসনে দুর্নীতি ও রাজনীতিকে ‘প্রাতিষ্ঠানিক’ রূপ দিয়ে যান। প্রশাসন বিশ্লেষক সাবেক ও বর্তমান একাধিক আমলা এবং রাজনীতিবিদরা এমনটাই মনে করেন।
কিছুটা দ্বিমত পোষণ করে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, শীর্ষ পদের আমলাদের বাছাই করেন রাজনীতিবিদরা। তারা তাদের প্রয়োজনেই দুর্নীতিবাজদের বড় বড় পদে বসান। ফলে শুধু আমলাদের দুর্নীতির জন্য দায়ী করলে চলবে না। এখানে রাজনীতিবিদদেরও দায় আছে। শীর্ষ পদে নিয়োগ দিতে সততা ও দক্ষতা বিবেচনা করার পরামর্শ দেন তিনি।
ম খা আলমগীরেই পচন শুরু: বিশ্লেষকরা বলেন, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারি চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে ১৯৯৬ সালে বিতর্কিত ‘জনতার মঞ্চে’ যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে দেশের প্রশাসনকে পচনের দিকে নিয়ে যান একাধিক সচিবসহ শতাধিক কর্মকর্তা। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। আওয়ামী লীগের কাছ থেকে পুরস্কারও পেয়েছেন এই আমলা। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি ক্ষমতা ছাড়লে নতুন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ম খা আলমগীরকে পুরস্কার হিসেবে বানান শেখ হাসিনা। এক বছর পর তার দপ্তর পরিবর্তন করে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতাসীন হলে ২০১২ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি। একজন সরকারি আমলা হয়েও রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে অন্ধভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করে সংসদ সদস্য, মন্ত্রী এবং দলের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হওয়ার মধ্য দিয়ে অন্য কর্মকর্তাদেরও ক্ষমতালোভী ও দুর্নীতিবাজ করে তোলেন ম খা আলমগীরদের মতো আমলারা।
জনপ্রশাসন বিশ্লেষক মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, জনতার মঞ্চ বাংলাদেশের প্রশাসনের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষত। কর্মচারীরা চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে ক্ষমতার লড়াইয়ের আন্দোলনে যোগদানের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো প্রশাসনকে কলঙ্কিত করেন। আন্দোলনে অংশ নেওয়ারা পরে বড় বড় দপ্তরে পদায়ন পাওয়ায় অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাজনীতির সংস্পর্শে চলে যান। এই সংস্কৃতি থেকে বের হওয়া কঠিন।
পচনের পূর্ণাঙ্গ রূপ এইচ টি ইমামে : ২০০৯ সালে ফের ক্ষমতায় বসে এইচ টি ইমামের মতো একজন ‘নীতিহীন’ আমলাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক উপদেষ্টা করেন। তার হাতে দেশের রাজনীতি ও প্রশাসনের দেখভাল করার সীমাহীন ক্ষমতা ছেড়ে দেন শেখ হাসিনা। কর্মকর্তারা বলেন, প্রশাসনে নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি এবং ভোটবিহীন ১৪ ও ১৮ সালের প্রহসনের দুটি নির্বাচন আয়োজনে একক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন সাবেক এই আমলা। বিএনপি-জামায়াতসহ অন্য বিরোধী দলগুলোকে দমন-পীড়নের ফর্মুলাও দিতেন তিনি। তার নির্দেশেই প্রতিটি দপ্তরের কর্মকর্তা ওঠবস করতেন। এইচ টি ইমাম তার পছন্দ অনুযায়ী ও অনুগত কর্মকর্তাদের সীমাহীন ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ করে দেন। এসব কর্মকর্তা এইচ টি ইমামের সঙ্গে নিজেদের সখ্য দেখিয়ে সব ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেদের জড়ান।
কর্মকর্তারা আরও বলেন, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার, সাবেক মুখ্য সচিব ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে এমপি হওয়া আবুল কালাম আজাদ, সাবেক মুখ্য সচিব ও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের উপদেষ্টা (মন্ত্রীর মর্যাদা) ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী (বর্তমানে কারাবন্দি), সাবেক মুখ্য সচিব ও পরে ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী ড. আহমদ কায়কাউস, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মহিবুল হক (বর্তমানে কারাবন্দি), প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব সাজ্জাদুল হাসান, সাবেক মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সালাহ উদ্দিনসহ আরও কয়েকজন ছিলেন এইচ টি ইমামের আশীর্বাদপুষ্ট। তার আশ্রয়-প্রশ্রয়েই এসব কর্মকর্তা প্রশাসনে সীমাহীন ক্ষমতা ও দুর্নীতিতে জড়ান। গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারাও এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো রিপোর্ট করতে পারতেন না।
ভুক্তভোগী কর্মকর্তারা বলেন, ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের মার্চে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রশাসনকে নিজের মর্জিমতো চালিয়েছেন এইচ টি ইমাম। প্রশাসনে নতুন নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন তার সম্মতি ছাড়া হতো না। বিতর্কিত একাধিক বিসিএস পরীক্ষায় কট্টর ছাত্রলীগ করা প্রার্থীদের নিয়োগে জালিয়াতি ও প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি ছিল অনেকটা ওপেন সিক্রেট। তার ইশারা ছাড়া কোনো দপ্তরই নড়ত না। একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার ও প্রশাসনকে পুরোপুরি আওয়ামীকরণে তার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। এইচ টি ইমামের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তার অনুসারীরা নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলি বাণিজ্যকে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মে পরিণত করেন।
তারা আরও বলেন, আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে এইচ টি ইমামের পাশাপাশি, ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী, ড. আহমদ কায়কাউস, মহিবুল হক, সাজ্জাদুল হাসান, তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, সালাহ উদ্দিন প্রশাসনকে নিজেদের সম্পত্তিতে পরিণত করেন। এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির ও প্রশাসনকে আওয়ামীকরণের অভিযোগগুলো ব্যাপক আলোচিত বিষয়। গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এসব কর্মকর্তা ছিলেন হাসিনার সবচেয়ে বিশ্বস্ত।
এমপি হন হাসিনার অনুগত আমলারা: ২০১৪ সালে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তাদের মিত্র জামায়াতে ইসলামীসহ বেশিরভাগ দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে একতরফা নির্বাচন করেন শেখ হাসিনা। প্রশ্নবিদ্ধ ওই নির্বাচনে ১৫৪টি আসনেই ভোটের প্রয়োজন হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্তির পর হাসিনাকে ক্ষমতায় বসাতে যে কজন আমলা ষড়যন্ত্র করেন, তাদের গুরু ছিলেন এইচ টি ইমাম। মূলত তার পরামর্শেই আমলারা পরপর তিনটি ভোটারবিহীন একপক্ষীয় নির্বাচন করেন। জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া হাসিনাকে বারবার ক্ষমতায় বসানোর দাবিদার কর্মকর্তারা ব্যাপক বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তাদের কেউ কেউ নৌকার মনোনয়নে ভোটবিহীন নির্বাচনে এমপি হওয়ার বাসনা জানান। শেখ হাসিনা তাদের সে বাসনা অপূর্ণ রাখেননি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ফরিদপুর-১ আসন থেকে সাবেক সিনিয়র সচিব মনজুর হোসেন বুলবুলকে এমপি বানান হাসিনা। ২০২৩ সালে নেত্রকোনা-৪ (মদন-মোহনগঞ্জ-খালিয়াজুরী) আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হন সাবেক সিনিয়র সচিব সাজ্জাদুল হাসান। সাজ্জাদুল হাসানের বড় ভাই ওবায়দুল হাসানকে দেশের প্রধান বিচারপতি বানিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
২০২৪ সালের নির্বাচনে চার সচিব নৌকার টিকেটে একতরফা ভোটে এমপি নির্বাচিত হন। তারা হলেন সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, সাবেক সচিব ও পিএসপির সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব সাজ্জাদুল হাসান (দ্বিতীয়বার) এবং সাবেক সিনিয়র সচিব সৌরেন চক্রবর্ত্তী।
নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে তহবিল তৈরি: প্রত্যক্ষদর্শী কর্মকর্তাদের ভাষ্য, সচিবরা চাকরিরত অবস্থায় নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে নির্বাচনী তহবিল তৈরিতে নেমে পড়তেন। নির্বাচনের অর্থ জোগাতে তারা নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করে অবৈধ অর্থের পাহাড় গড়েছেন। অফিসার্স ক্লাবের সাবেক সেক্রেটারি ও সাবেক সচিব মেজবাহ উদ্দিন ভোলা থেকে নির্বাচন করবেন, এমন ঘোষণা দিয়েছিলেন যুগ্ম সচিব থাকাকালেই। নির্বাচনী অর্থ জোগাড় করতে তিনি বহু অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন। আওয়ামী লীগের পতনের তিনি গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন।
সূত্র জানায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের একচ্ছত্র আধিপত্য আর ক্ষমতার অপব্যবহার দেখে অন্য আমলারাও রাজনীতিতে জড়িয়ে নিজেদের আখের গোছাতে থাকেন। ভোটবিহীন হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর দাবিদার আমলারা নিজেদের মতো করেই প্রশাসনে দাপট দেখাতে থাকেন। কর্মকর্তারা নিজেদের ছাত্রলীগের সাবেক নেতাকর্মী কিংবা আওয়ামী পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য দাবি করে অবৈধভাবে নানা সুযোগ-সুবিধা নিতে থাকেন।
প্রশাসন বিশ্লেষকদের ভাষ্য, আমলাদের একটি অংশ যদি একচেটিয়া ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, তখন স্বাভাবিকভাবেই অন্যরা আর বসে থাকেন না। যে যার মতো করেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এভাবে মূলত প্রশাসন নষ্ট হয়েছে। কারণ প্রশাসনের শীর্ষ পদের আমলারা সৎ থাকতে পারলে তারা শুদ্ধতার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। আর নিজেরাই যদি দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিতে জড়ান তাহলে অন্যদের সৎ থাকা, এটা বলার নৈতিক শক্তি থাকে না।
-Kalbela