আইন- আদালত

যুক্তরাষ্ট্রের আইনে ডিম ছোড়া কি অপরাধ, বাংলাদেশে শাস্তি কী

11953_IMG_1590.jpeg

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেনকে নিউইয়র্কে হেনস্তার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দলটির নেতারা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ঘটনার সমালোচনা চলছে। প্রশ্ন উঠেছে, প্রতিবাদের ভাষা কি ডিম ছুড়ে মারা হতে পারে, নাকি এটি যুক্তরাষ্ট্রে ফৌজদারি অপরাধ?

বাংলাদেশ সময় সোমবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে আখতার হোসেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি (জেএফকে) বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার সময় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের হাতে হেনস্তার শিকার হন। বাংলাদেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা দলটির নেতা-কর্মীরা আখতারের পিঠে ডিম ছুড়ে মারেন।

পশ্চিমা দেশসহ বিভিন্ন দেশেই ডিম ছুড়ে মারার ঘটনা ঘটে। এর ইতিহাসও পুরোনো।ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৬৩ খ্রিষ্টাব্দে রোমান গভর্নর ভেসপাসিয়ানকে শাস্তিমূলক নীতিতে ক্ষুব্ধ প্রজারা শালগম ছুড়ে মেরেছিল।

মধ্যযুগে ডিম প্রবেশ করে এ তালিকায়। তখন বন্দীদের প্রকাশ্যে একসঙ্গে বেঁধে ডিম ছুড়ে মারা ছিল নিয়মিত ঘটনা। এলিজাবেথীয় যুগে নাট্যমঞ্চে খারাপ অভিনয়ের প্রতিবাদে দর্শকেরা পচা ডিম ছুড়ত, যা আজকের রাজনৈতিক নাট্যমঞ্চে ব্যবহারের সঙ্গে খুব একটা বেমানান মনে হয় না।

তবে ডিম ছুড়ে মেরে ব্যক্তিকে আঘাত করা বা সম্পদের ক্ষতি করা কি বৈধ?

যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের ওয়েবসাইট ঘেঁটে ও আইনকানুন পড়ে জানা যায়, সেখানে কোনো ব্যক্তিকে যেকোনো বস্তু দিয়ে আঘাত করা অপরাধ। বিচারের ক্ষেত্রে দেখা হয়, ঘটনাটি মজার ছলে করা হয়েছে কি না, ঘটনাটি কারও প্রতি ঘৃণা থেকে করা হয়েছে কি না, অথবা বড় কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে কি না?

অভিযুক্ত ব্যক্তির মূল উদ্দেশ্য কী ছিল, সেটি পুলিশের তদন্তে প্রমাণিত হতে হবে।আইনজীবী যা বললেন

অন্তর্বর্তী সরকারের কেউ পশ্চিমা দেশগুলো সফরে গেলে তাঁদের কেন্দ্র করে বিক্ষোভ করছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। ডিম ছুড়ে মারার ঘটনাও ঘটেছে।

যুক্তরাজ্যের লন্ডনে ১২ সেপ্টেম্বর তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের গাড়ি লক্ষ্য করে ডিম ছুড়ে মারেন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা। যদিও পরে বাংলাদেশ হাইকমিশন জানায়, মাহফুজ গাড়িতে ছিলেন না। এবার আখতারকে লক্ষ্য করে ডিম ছুড়ে মারা হলো নিউইয়র্কে।

আখতার হোসেনকে যুবলীগ কর্মী মিজানুর ডিম ছোড়েন বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। তাঁকে পুলিশ আটক করেছে। অবশ্য আটক করা হয়েছে বিএনপির এক কর্মীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে। বিএনপি কর্মী পুলিশকে বলেছিলেন, মিজানুর তাঁকে ছুরি দিয়ে আঘাত করতে চেয়েছিলেন।

ডিম ছোড়ার বিষয়টি নিয়ে নিউইয়র্কে কর্মরত আইনজীবী মীর মো. মিজানুর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জেএফকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আখতারের ওপর ডিম নিক্ষেপের ঘটনাটি কোনো হালকা ঘটনা নয়। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ফৌজদারি আইন অনুযায়ী অপরাধ। এ ধরনের অপরাধের জন্য জেলও হতে পারে, শারীরিক আঘাত হলে শাস্তি আরও কঠিন হয়।মিজানুর রহমান আরও বলেন, নিউইয়র্ক রাজ্যের কিছু সাধারণ আইনে এ ঘটনাকে হয়তো হয়রানি বা আক্রমণ বলা যেত। কিন্তু যেহেতু ভুক্তভোগী জাতিসংঘের ৮০তম অধিবেশনে অংশ নিতে একটি দেশের সরকারপ্রধানের সফরসঙ্গী হিসেবে এসেছেন, তাই এ ক্ষেত্রে ফেডারেল আইন প্রযোজ্য হবে।

‘যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো বিদেশি প্রতিনিধিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ ঘটনার গুরুত্ব তাই অত্যন্ত বেশি’, বলেন মীর মো. মিজানুর রহমান। তিনি মনে করেন, আখতার যেহেতু জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের সঙ্গে এসেছেন, সেহেতু তিনি আন্তর্জাতিকভাবে সুরক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হবেন।

জাতিসংঘের কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব ক্রাইমস অ্যাগেইনস্ট ইন্টারন্যাশনালি প্রোটেক্টেড পারসনস, ইনক্লুডিং ডিপ্লোমেটিক এজেন্টস, ১৯৭৩ অনুযায়ী, যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে আন্তর্জাতিকভাবে সুরক্ষিত কোনো ব্যক্তির ওপর আক্রমণ চালায়, হুমকি দেয়, হামলায় সহযোগিতা বা অংশ নেয়, তাহলে প্রতিটি দেশকে তাদের নিজস্ব আইনে একে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে।অধ্যাপক ইউনূসের সফরসঙ্গী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া আখতার হোসেন আন্তর্জাতিকভাবে সুরক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হবেন কি না, জানতে চাওয়া হয়েছিল সাবেক কূটনীতিক এম হুমায়ুন কবিরের কাছে। তিনি বলেন, সাধারণত রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান এ মর্যাদা পান। তাঁদের সফরসঙ্গীরা সাধারণত পান না।

ডিম ছোড়া অপরাধ কি না, সে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত আরেক আইনজীবীর বক্তব্য নিয়েছে প্রথম আলো। তাঁর নাম খাইরুল বাশার। প্রথম আলোর নিউইয়র্ক প্রতিনিধি খাইরুল বাশারকে তিনি বলেন, নিউইয়র্কে এটা অপরাধ, তবে গুরুতর নয়। তবে নির্ভর করে পুলিশ কীভাবে অভিযোগপত্র লিখছে, তার ওপর।

খাইরুল বাশার বলেন, সাধারণত এসব অপরাধে প্রবেশনমূলক শাস্তি হয়ে থাকে এবং মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। অঙ্গীকার নেওয়া হয় যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এ ধরনের অপরাধ আর করবেন না।গালাগাল করা কী অপরাধ

অধ্যাপক ইউনূসের সফরসঙ্গী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছেন ছয়জন রাজনীতিবিদ। তাঁরা হলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির এবং জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে নকিবুর রহমান তারেক, যিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকেই প্রতিনিধিদলে যোগ দেবেন।

সোমবার রাতে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা শুধু আখতারকে হেনস্তা করেনি, মির্জা ফখরুল ও তাসনিম জারার উদ্দেশে তাঁরা কটূক্তি করেছেন। বিশেষ করে জারার উদ্দেশে অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে।

আইনজীবীরা বলছেন, মৌখিকভাবে যা-ই বলা হোক, তাঁকে অপরাধ হিসেবে প্রমাণ করা যুক্তরাষ্ট্রের আইনে কঠিন। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে কারও ওপর আঘাত করার সুযোগ নেই।

বাংলাদেশে শাস্তি কী

বাংলাদেশের আইনজীবীরা বলছেন, দেশে কোনো ব্যক্তি কাউকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ডিম নিক্ষেপ করলে আদালতে তার প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ আছে।

বিষয়টি নিয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী প্রথম আলোকে বলেন, কোনো ব্যক্তি কাউকে সামাজিকভাবে হেনস্তা করতে ডিম ছুড়ে মারলে ভুক্তভোগী ব্যক্তি মানহানির মামলা করতে পারেন।

দেশের আদালত চত্বরে সাম্প্রতিক ডিম ছোড়ার ঘটনাগুলোর বিষয়ে পিপি ফারুকী বলেন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকে আদালত চত্বরে ডিম ছোড়ার ঘটনা ঘটেছিল। তবে তাঁরা এ ধরনের ঘটনাকে সমর্থন করেন না।

ফারুকী আরও বলেন, আখতার হোসেনের ওপর ডিম নিক্ষেপের ঘটনাটি প্রতিশোধের নেশায় তাঁর সম্মানহানি করার জন্য করা হয়েছে।
 

সর্বাধিক পঠিত


ভিডিও