লায়লা খন্দকার
বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী টিকা নিয়ে গবেষণা করছেন। টিকা সহজলভ্য করার জন্য তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। এর ফলে অসংখ্য মানুষ উপকৃত হয়েছে। স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি এ বছর ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পেয়েছেন। র্যামন ম্যাগসাইসাই কমিটি বলেছে, এই পুরস্কার বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের, বিশেষত নারী বিজ্ঞানীদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
কিছুদিন আগে সিঙ্গাপুরভিত্তিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক পত্রিকা এশিয়ান সায়েন্টিস্ট হানড্রেড লিস্ট–এর ষষ্ঠ সংস্করণে আইসিডিডিআরবির ড. ফেরদৌসী কাদরী, মডেল লাইভস্টক অ্যাডভান্সমেন্ট ফাউন্ডেশনের ড. সালমা সুলতানা ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিয়া সাবরিনার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় এশিয়া মহাদেশের ‘সেরা ও উজ্জ্বলতম বিজ্ঞানীদের সাফল্যগুলো’ উদ্যাপনের উদ্দেশ্যেই এ তালিকা প্রকাশিত হয়। আরেক বাংলাদেশি তরুণ জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী তনিমা তাসনিম কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে অসামান্য কাজ ও গবেষণা করেছেন। এ জন্য তিনি সায়েন্স নিউজ (এসএন) ম্যাগাজিনের ‘এসএন টেন: সায়েন্টিস্টস টু ওয়াচ’ তালিকার ২০২০ সংস্করণে শীর্ষ স্থান অর্জন করেন।
এসব অর্জন তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করি, যেখানে ১৬ বছর বয়সী মেয়েদের কোনো বিজ্ঞানীর ছবি আঁকতে বলা হলে, মাত্র ২৫ শতাংশ নারী–বিজ্ঞানীর ছবি আঁকে। গবেষণায় জানা যায়, ১৫ বছর বয়সের মধ্যেই মেয়েরা সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যাথমেটিকস (স্টেম) বিষয়ে পড়াশোনার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। তবে ছেলেদের ক্ষেত্রে এটা হয় না।
ইউনিসেফের ‘টুয়ার্ডস অ্যান ইকুয়াল ফিউচার রি–ইমাজিনিং গার্লস এডুকেশন থ্রু স্টেম’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মেয়েরা স্টেম নিয়ে পড়াশোনা করার ক্ষেত্রে অনেক বাধার মুখোমুখি হয়। বেশির ভাগ দেশে পড়ার দক্ষতায় মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে আছে। কিন্তু স্টেম বিষয়ে পড়াশোনার ক্ষেত্রে তাদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। জরিপে অংশ নেওয়া ৭৮ দেশের মধ্যে ৭২টি দেশেই মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিষয়ে পেশা গড়তে বেশি আগ্রহী।
তনিমা তাসনিম এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তাঁর মা তাঁকে মঙ্গল গ্রহে পাথফাইন্ডার মহাকাশযানের অবতরণের গল্প শোনাতেন। এ গল্প শুনেই তিনি বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর। এটি ব্যতিক্রম উদাহরণ। স্টেমকে সাধারণত পুরুষদের বিষয় হিসেবে দেখা হয়। মেয়েরা কী করবে অথবা তাদের কী করা উচিত, সে ব্যাপারে সামাজিক রীতিনীতি এবং মা-বাবা ও শিক্ষকদের প্রত্যাশা তাঁদের প্রভাবিত করে। শিক্ষক ও মা–বাবার সনাতন ধ্যানধারণার কারণে মেয়েরা স্টেম বিষয়ে পড়াশোনায় নিরুৎসাহিত হয়।
কোনো ক্ষেত্রে অর্থপূর্ণ কাজ করা এবং শীর্ষে আরোহণের জন্য যে পরিবেশ প্রয়োজন, তা বাংলাদেশে নারীরা পান না। কর্মক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য এবং অসংবেদনশীল আচরণের শিকার হন তাঁরা। পেশা নিয়ে উচ্চাভিলাষী নারীকে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়।
মানুষ যা দেখে না, তা হতেও পারে না। স্টেমসহ নানা পেশায় সফল নারীদের না দেখলে মেয়েরা সাফল্যের স্বপ্ন কীভাবে দেখবে? জনপ্রিয় টেলিভিশন অনুষ্ঠান, পত্রিকা, সিনেমা, বিজ্ঞাপনে এমনভাবে নারীদের তুলে ধরা হয়, যেন সৌন্দর্যচর্চা, ঘরের সব কাজ একা করা এবং সন্তানের যত্ন নেওয়াটাই নারীর জীবন। পেশাগত ক্ষেত্রে সাফল্যের অধিকারী নারীর ফ্যাশন বা ঘরকন্নার কাজ নিয়ে এ ধরনের প্রতিবেদন বিভ্রান্তির বার্তা দেয়। ঘরে-বাইরে সব কাজ একসঙ্গে সমানতালে সামলানো ‘সুপার উইমেন’ অবাস্তব একটা ব্যাপার। কিন্তু গণমাধ্যম এটা প্রচার করে যাচ্ছে। এই প্রবণতা সমাজের জন্য ক্ষতিকর। এটা নারীদের মানসিক চাপে ফেলে।
কোনো ক্ষেত্রে অর্থপূর্ণ কাজ করা এবং শীর্ষে আরোহণের জন্য যে পরিবেশ প্রয়োজন, তা বাংলাদেশে নারীরা পান না। কর্মক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য এবং অসংবেদনশীল আচরণের শিকার হন তাঁরা। পেশা নিয়ে উচ্চাভিলাষী নারীকে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর পেশাগত সাফল্যের খুব একটা উদ্যাপন নেই। নারীরা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে স্টেমসহ অন্যান্য বিষয়ে ভালো ফলাফল করছেন। কিন্তু পেশায় ঢোকার আগেই তাঁদের অনেকের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ বিয়ে এবং সন্তান জন্মের পর চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। উচ্চশিক্ষা ও পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ নিতে পারেন না। এরপরও সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিকূলতা জয় করে কিছু নারী নিজেদের মেধা, যোগ্যতা, কঠোর পরিশ্রম, একাগ্রতা ও আত্মবিশ্বাসের জোরে নিজ নিজ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে যাচ্ছেন।
প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি শিক্ষা, কর্মসংস্থান, যোগাযোগ, স্বাস্থ্যসেবা, বিনোদনসহ সমাজের সবকিছুকেই প্রভাবিত করছে। এটি আমাদের ভবিষ্যৎ তৈরি করবে। স্টেমে পড়াশোনা না করলে নারীদের বেকার থাকার আশঙ্কা রয়েছে। তাঁরা অল্প বেতনের চাকরি করতে বাধ্য হবেন। তাঁদের কিছু পেশা হয়তো স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতির কারণে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আমরা যদি আগামী পৃথিবী সৃষ্টিতে নারীর সমান অংশগ্রহণ চাই, তাহলে অবশ্যই স্টেম শিক্ষা এবং পেশায় তাঁদের উৎসাহিত করতে হবে।
এ জন্য যা করা প্রয়োজন
—যেসব মেয়ে স্টেম বিষয়ে পড়তে আগ্রহী, তাদের প্রায় অর্ধেকই স্টেম–সংক্রান্ত পেশায় সফল কোনো নারীকে চেনে না। তাদের সামনে সফল নারী রোল মডেলদের তুলে ধরতে হবে। স্টেম পেশায় সুপ্রতিষ্ঠিত নারীরা তাদের পরামর্শ দিতে পারেন।
—শিক্ষকেরা মেয়েদের সঙ্গে স্টেম নিয়ে কথা বললে এবং উৎসাহ দিলে তারা এ বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মেয়েশিক্ষার্থীদের হাতে–কলমে কাজের সুযোগ করে দেওয়া প্রয়োজন।
—মা-বাবার দায়িত্ব হচ্ছে ছেলে ও মেয়েশিশুদের সমানভাবে বেড়ে উঠতে সহায়তা করা, যাতে তারা নারী ও পুরুষের কাছে সমাজের প্রত্যাশিত আচরণের সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ না থাকে।
—রাষ্ট্রকে এমন নীতি প্রণয়ন করতে হবে, যাতে কর্মজীবী মা-বাবা সন্তান বড় করার জন্য সবেতন ছুটি পান। কর্মক্ষেত্রে নিয়োগদাতাদের এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে নারী ও পুরুষ উভয়ই পেশাগত কাজ এবং সন্তান বড় করাসহ ঘরের কাজের দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
—গণমাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল নারীর জীবনসংগ্রাম বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন। দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এনে নারীদের পড়াশোনা ও পেশাগত অর্জনকে গুরুত্ব দেওয়া শিখতে হবে।
লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী