আদানি এখন বিশ্ব জুড়ে আলোচনায়। দেশে দেশে রয়েছে ভীষণ চাপে। এরই মধ্যে আদানি গ্রুপের সঙ্গে করা দু’টি চুক্তি বাতিল করেছে কেনিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে বিপুল অঙ্কের ঘুষকাণ্ডে ফেঁসে গেছেন ভারতের ধনকুবের গৌতম আদানি। তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে নিউ ইয়র্কের গ্রান্ড জুরি। ওদিকে অস্ট্রেলিয়ায় আদানির কয়লা খনিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। এ অবস্থায়বিভিন্ন দেশে আদানির চুক্তিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আর বাংলাদেশের সঙ্গে অসম বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি নিয়েও এখন কাঠগড়ায় আদানি গ্রুপ। এ অবস্থায় কী করবে বাংলাদেশ। ওদিকে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে এ চুক্তি নিয়ে একটি রিট করা হয়েছে। আদালত রুলসহ একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি করার নির্দেশ দিয়েছেন। রুলে অসম, অন্যায্য ও দেশের স্বার্থ পরিপন্থি দাবি করে চুক্তিটি কেন বাতিল করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জ্বালানি ও আইন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। মঙ্গলবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন। শুধু তাই নয়, ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইনে আদানিকে নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, ঘুষকাণ্ডে নাম জড়ানোর পরেই শিল্পপতি গৌতম আদানিকে গ্রেপ্তার করার দাবিতে সরব হলেন কংগ্রেস, শিবসেনা, আপ-এর শীর্ষ নেতারা।
এ ছাড়া ভারতের কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীও আদানিকে অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন আদানিকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করা উচিত।
রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়েছে, ভারতের আদানি শিল্পগোষ্ঠীর সঙ্গে ২৫০ কোটি ডলারের বেশি অর্থের চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে আফ্রিকার দেশ কেনিয়া। নিউ ইয়র্কের আদালতে ঘুষকাণ্ডের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আদানি এবং তার ভাতিজা সাগর আদানির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পরপরই এমন সিদ্ধান্ত জানিয়েছে কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো। বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে এ কথা জানান তিনি। ভাষণে তিনি বলেন, আমাদের তদন্ত সংস্থা ও অংশীদার দেশগুলোর দেয়া নতুন তথ্যের ভিত্তিতে চুক্তিগুলো বাতিল করা হয়েছে। যদি দুর্নীতির বিষয়ে নিশ্চিত প্রমাণ বা বিশ্বাসযোগ্য তথ্য আসে, আমি কঠোর পদক্ষেপ নিতে পিছপা হবো না। তার এই বক্তব্যে কেনিয়ার সংসদ সদস্যরাও সায় দিয়েছে। কেনিয়ার জোমো কেনিয়াত্তা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দ্বিতীয় রানওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশটির সঙ্গে প্রায় ২০০ কোটি ডলারের চুক্তি ছিল আদানি গ্রুপের। পাশাপাশি জ্বালানি ও পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকেও অবিলম্বে চুক্তি বাতিলের নির্দেশ দিয়েছেন রুটো। কেনিয়ার তদন্তকারী সংস্থা ও অংশীদার দেশগুলোর কাছ থেকে পাওয়া নতুন তথ্যের আলোকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন রুটো।
যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে অভিযুক্ত আদানির সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গেও চলছে টানাপড়েন। কয়েকদিন আগে আদানির সঙ্গে দেশের ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চুক্তির তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশের হাইকোর্ট। ওই নির্দেশের এক দিন পরেই যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে ঘুষকাণ্ডে অভিযুক্ত হয়েছেন আদানি এবং তার কর্মকর্তারা। এক্ষেত্রে আদানি গ্রুপ বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও চাপে পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। দ্য হিন্দুর এক খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পতিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আদানি গ্রুপের চুক্তিটি শুরু থেকেই বেশ বিতর্কিত ছিল। কেননা, হাসিনা সরকার স্বাভাবিক নিয়ম মেনে এই চুক্তি করেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। এরপরেও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ইতিবাচক ধারায় আগানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু মার্কিন আদালতে অভিযুক্ত হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের চলমান ধারা কিছুটা সংকুচিত হতে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রফেসর ড. ইজাজ হোসেন। আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তিটি বর্তমানে অনেকটাই অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে জি-টু-জি চুক্তির অধীনে ভারত থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে। ৫ই আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে আদানির ২০১৭ সালের বিদ্যুৎ চুক্তি। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরপরই কয়লা, বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো যাচাইয়ে কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই কমিশনের নেতৃত্বে রয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি’র সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। আদানির সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার সংলাপের পথে হাঁটলেও মার্কিন মুল্লুকের খবরের পর তার বাঁক বদল হতে পারে। কার্যত চাপে পড়তে পারে আদানি ও তার প্রতিষ্ঠান।
অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়াতেও চাপে পড়েছে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী গৌতম আদানি। সেখানে তার কয়লা খনির কর্মীদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। চলতি সপ্তাতেই এই অভিযোগের কবলে পড়েছে আদানির প্রতিষ্ঠান। কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের নাগানা ইয়ারবাইন ওয়াঙ্গান অ্যান্ড জাগালিংগু কালচারাল কাস্টোডিয়ানস জানিয়েছে, ব্রাভাস মাইনিং অ্যান্ড রিসোর্সেস ইউনিটের বিরুদ্ধে গুরুতর বর্ণবৈষম্যের অভিযোগ এনে তারা এ সপ্তাহের শুরুতে অভিযোগ দায়ের করেছে। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, আদানির কর্মীরা আদানির কারমাইকেল কয়লা খনির কাছে আদিবাসী গোষ্ঠীর সদস্যদের বিভিন্নভাবে বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে। নাগানা ইয়ারবাইনের সিনিয়র কালচারাল কাস্টোডিয়ান আদ্রিয়ান বুরাগুব্বা এক বিবৃতিতে বলেন, আমরা বছরের পর বছর ধরে আদানির কাছ থেকে বৈষম্য সহ্য করেছি, আর সহ্য করা যাচ্ছে না। তারা বলেন, গত বছর আমাদের আইনজীবীরা আদানির কর্মীদেরকে তাদের উদ্বেগজনক আচরণের জন্য নোটিশ দিয়েছেন। কিন্তু তারপরেও তারা এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে অস্বীকার করেছেন। এক্ষেত্রে আইনি লড়াইয়ের কথা জানিয়েছেন তারা।
তবে এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হচ্ছে আদানি ইস্যুতে দিল্লির সঙ্গে সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে কি-না। যেহেতু আদানি নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ লোকদের একজন। এক্ষেত্রে হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, তারা আদানির বিষয়ে অবগত রয়েছে। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি কারিন জিন পিয়ের বলেন, স্পষ্টতই আমরা আদানির বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে সচেতন। এক্ষেত্রে বাকি কিছু জানতে হলে সবাইকে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এবং বিচার বিভাগের কাছে যেতে হবে। জিন পিয়েরে যোগ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের সম্পর্কের বিষয়ে আমরা বিশ্বাস করি যে, এই সম্পর্ক আমাদের জনগণের। বৈশ্বিক সমস্যা নিরসনে আমরা উভয়ই একটি শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছি।