গত ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাত করেন ইলন মাস্ক। ওই সাক্ষাতে মোদিকে একটি উপহার দেন স্পেসএক্স ও টেসলার প্রধান মাস্ক। একই সঙ্গে তিনি তার পরিবারের সদস্যদের সাথে মোদিকে পরিচয় করিয়ে দেন। ওই সাক্ষাতকারকে মোদি ‘খুবই ভাল’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। খবর আল জাজিরা
ওই সফরে মোদি মূলত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু এর মধ্যে তিনি মাস্কের সঙ্গেও সাক্ষাত করেন। ওই সাক্ষাতে মোদি এবং মাস্কের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), মহাকাশে অনুসন্ধান, উদ্ভাবন এবং স্থায়ী উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা হয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় তাদের বৈঠকের বিষয়ে সে সময়ে এ তথ্য জানায়।
কিন্তু এই আলোচনার এক মাস পার হতেই ইলন মাস্কের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স প্লাটফর্ম ভারত সরকারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। এতে অভিযোগ করা হয়েছে, নয়াদিল্লি বেআইনিভাবে অনলাইন কনটেন্টে সেন্সর (ঘষামাজা) করছে।
ইলন মাস্কের মালিকানাধীন এক্স প্লাটফর্ম এমন এক সময় এই মামলা করেছে, যখন ভারতে তিনি স্টারলিংক এবং টেসলার কার্যক্রম চালু করতে যাচ্ছে।
মোদির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলার মাঝেই কেন এমন মামলা?
গত ৫ মার্চ দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য কর্ণাটকের উচ্চ আদালতে মামলা দায়ের করে এক্স। এতে বলা হয়, ভারত সরকার ‘একটি অগ্রহণযোগ্যে একপেশে কৌশল’ ব্যবহার করছে। যার মাধ্যমে অনলাইন কনটেন্ট বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও সরকারি কর্মকর্তা এবং মন্ত্রণালয়কে বেআইনিভাবে অনলাইন থেকে অবৈধ কনটেন্ট সরিয়ে ফেলার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যা দেশটির তথ্য প্রযুক্তি আইন বিরোধী এবং মুক্ত মত প্রকাশ স্বাধীনতার লঙ্ঘন।
ভারতের ৬৯এ ধারার যে প্রযুক্তি আইন রয়েছে, সেটি ২০০০ সালের অক্টোবরে পাস হয়। এই আইনে ভারতের আইটি মন্ত্রণালয়কে জাতীয় নিরাপত্তা এবং সামাজিক শিষ্টাচার বহির্ভূত কনটেন্ট অপসারণের ক্ষমতা দেয়া হয়। তবে এতে একটি আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, যেখানে আইটি মন্ত্রণালয়কে ইলেকট্রনিক্স এবং তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে কনটেন্ট অপসারণের অনুমতি চেয়ে আবেদন করতে হয়। ইলেকট্রনিক্স এবং তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় কনটেন্টটি পর্যালোচনা করার পর সেন্সরের সিদ্ধান্ত নেয়।
তবে ভারত সরকার বর্তমানে আইটি আইন ৭৯(৩)(বি) ধারায় নতুন একটি কৌশল চালু করেছে। যেখানে কনটেন্ট ডিলিট করার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া এই আইনের অধীনে আলাদা ব্লকিং প্রক্রিয়া রয়েছে।
৭৯(৩)(বি) ধারা অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তা একটি নোটিফিকেশন পদ্ধতি অনুসরণ করে অনলাইন থেকে কনটেন্ট অপসারণ করতে পারেন। এজন্য কনটেন্ট মুছতে সরকারি পোর্টাল ‘সহায়োগে’ নোটিশ পাঠাতে হবে। তবে এই পোর্টালটি কোনো আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে না।
ভারত সরকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্লাটফর্মগুলোকে সহায়োগ পোর্টালে সাইন আপ করতে নিয়ম করেছে। এক্ষেত্রে আপত্তি জানিয়ে এক্স বলছে, এর মাধ্যমে সরকার ইচ্ছামত সেন্সরশিপ করতে পারবে।
ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও আইনজীবী আপার গুপ্তা আল জাজিরাকে বলেন, সহায়োগ পোর্টালের মাধ্যমে যে নতুন আইনি সেন্সরশিপ ক্ষমতা তৈরি করা হয়েছে তাতে কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই। যেমন একটি নির্দিষ্ট কর্মকর্তার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সেন্সরশিপ অনুরোধ পাঠানোর প্রয়োজন। কিন্তু এখন এটি যেকোনো সরকারি বিভাগের মাধ্যমে করা যাবে। যেখানে একজন কর্মকর্তাকে নিযুক্ত করে যেকোনো কনটেন্ট অপসারণের অনুরোধ পাঠাতে পারবে। যার উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নয়াদিল্লিতে রেল স্টেশনে পদদলিত হয়ে নিহতের ঘটনায় প্রায় ২০০টি ভিডিও অপসারণে এক্সকে নির্দেশ দেয় রেলওয়ে মন্ত্রণালয়।
গুপ্তা বলেন, সরকারের এধরনের একমুখী সেন্সরশিপ প্রক্রিয়া একটি অবৈধ পদক্ষেপ। যার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে এক্সের।
ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সদস্য এবং সাবেক আইটি মন্ত্রী রাজিব চন্দ্রশেখর ভারতীয় সংবাদ সংস্থা এএনআইকে বলেন, ‘ভারত একটি দেশ, ফলে সে সবখানেই আইন প্রয়োগ করতে পারে। এক্সেরও অধিকার রয়েছে আদালতে যাওয়ার।’
ভারত সরকারের বিরুদ্ধ এক্সের করা মামলাটি গত ২০ মার্চ ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়। আগামী ২৭ মার্চ কর্ণাটকের উচ্চ আদালতে এ মামলার শুনানি হবে।
মামলা ফলে ভারতে মাস্ক কতটা ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন?
এই মামলার ফলে ইলন মাস্ক ভারতে কতটা চাপের মুখে পড়তে পারেন সেটা অনিশ্চিত বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে ওয়াশিংটন ডিসি ভিত্তিক থিংকট্যাঙ্ক দ্য উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান আল জাজিরাকে বলেন, ভারত সরকারের বিরুদ্ধে মাস্কের মালিকানাধীন এক্সের মামলা তেমন প্রভাব পড়বে না। কারণ ভারত জুড়ে ইলন মাস্কের ব্যাপক বিনিয়োগ রয়েছে।
এছাড়া তিনি মার্কিন সরকারে নতুন দায়িত্ব পেয়েছেন। এই দায়িত্ব পাওয়ার পরই হাজার হাজার কোটি ডলার অপচয় রোধে গণহারে সরকারি কর্মীদের ছাঁটাই করেছেন মাস্ক।
ট্রাম্পের বলয়ে থেকে ইলন মাস্ক কখনও নয়া দিল্লিকে অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলবে না। কারণ তিনি ভারতে স্টারলিংক এবং টেসলার কার্যক্রম চালু করতে কাজ করতে যাচ্ছেন। তবে এক্স ব্যবহারকারীদের জন্য মাস্ক মুক্তমত প্রকাশে লড়াই চালিয়ে যাবেন। এক্ষেত্রে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে এক্সের মামলা দুই দেশের সম্পর্কে তেমন প্রভাব ফেলবে না।