ইসলাম

তৃতীয় লিঙ্গের ঋতুর জয় ও নোংরা কিছু মানুষের মানসিকতা

697_download (2).jpg

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে একজন তৃতীয় লিঙ্গের নজরুল ইসলাম ঋতুর জয় অসংখ্য মানুষকে অসাধারণ আনন্দের উপলক্ষ এনে দিয়েছেন। তবে আনন্দের কারণ এবং ধরন সবার ক্ষেত্রে এক না।
সামাজিক মাধ্যমে দেখলাম তার জয় কিছু মানুষের হাতে ক্ষমতাসীন দলকে ঘায়েল করার এক অস্ত্র তুলে দিয়েছে। তারা তার জয়কে ক্ষমতাসীনদের অজনপ্রিয়তার পরিমাণ হিসেবে দেখাচ্ছেন। তাদের কথার ধরন অনেকটা এরকম– ‘আওয়ামী লীগ এখন এত অজনপ্রিয় হয়ে পড়েছে যে তারা এমনকি একজন তৃতীয় লিঙ্গের কাছেও হেরে যায়।’ এভাবে লিখে অনেকেই ঋতুর জয়কে ‘উপভোগ’ করছেন।

যারা এ ধরনের মন্তব্য করছেন তারা কি একবারও ভেবে দেখছেন এমন মন্তব্যের মাধ্যমে ওই মানুষটাকে কতটা তাচ্ছিল্যের শিকার করছেন? তবে সম্ভবত এটা সত্যি, ভেবে দেখলেও তারা একজনকে তাচ্ছিল্য হয়তো করতেনই, ক্ষুব্ধতাও দেখাতেন। এই সমাজের অসংখ্য মানুষের কাছে তারা ভীষণই ‘নোংরা’।  

তারা যদি নোংরাই না হবে তাহলে আমাদের মতো ভদ্রলোকদের সমাজে লৈঙ্গিক ভিন্নতা থাকে না কেন? প্রকৃতিগতভাবেই যে ০.১ শতাংশ মানুষের লৈঙ্গিক ভিন্নতা থাকার কথা সেই অনুপাতের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ তো আমাদের, তথাকথিত ভদ্রলোকের সমাজেও থাকার কথা। আমরা নোংরা মনে করি বলেই ওদের আমাদের মধ্যে থাকতে দেই না। ওদের চলে যেতে হয় কিংবা বাধ্য করা হয় অন্য তৃতীয় লিঙ্গদের দলের সঙ্গে ভিড়তে হয়।

নজরুল ইসলাম ঋতুর ক্ষেত্রেও ঘটেছিল একই ঘটনা। তারা মোট সাত ভাইবোন। তার মধ্যে তিনি তৃতীয় লিঙ্গের। বিষয়টি গ্রামে জানাজানি হওয়ার পর তিনি আর টিকে থাকতে পারেননি পরিবারে। ছোটবেলায়ই তাকে বাধ্য হয়ে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে যেতে হয়। তখন থেকেই ঢাকার ডেমরা এলাকায় একটি ‘হিজড়া কমিউনিটি’র সঙ্গে বেড়ে উঠেছেন তিনি।

লৈঙ্গিক ভিন্নতা যাদের রয়েছে তাদের প্রতি এই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝানোর জন্য আমার ব্যক্তিগত একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি। প্রায় একযুগ আগের কথা, একদিন দরজায় কলিং বেলের শব্দ শুনে পিপহোল দিয়ে তাকিয়ে দেখি একজন শাড়ি পরা নারী উল্টো ঘুরে আছেন। আমি দরজা খুলতে খুলতেই জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার, আপনি উল্টো ঘুরে আছেন কেন? তিনি ঘুরতে ঘুরতেই বলেছিলেন ‘ভাই, আমি তো হিজড়া, হেল্লাইগা’। আমার ভুল ভাঙলো – তিনি নারী নন। বাসায় একজন ‘হিজড়া’ চলে এসেছে দেখে আগ্রহ হলো তাঁর সাথে কথা বলতে, তাই তাঁকে ভেতরে নিয়ে বসালাম এবং কথা বলতে শুরু করলাম।

শুরুতেই নাম জিজ্ঞেস করতেই দেখি তিনি ভীষণ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। কারণ, তাঁর এই জীবনে খুব কম ‘স্বাভাবিক মানুষ’ই নাম জানতে চেয়েছে। জানলাম তাঁর নাম ‘নুরি’। দীর্ঘ আলোচনা হলো তাঁদের জীবন নিয়ে, জীবনের ভয়ংকর বঞ্চনা নিয়ে। আমরা অনেকেই রাস্তায় চলার সময় ‘ঠ্যাক’ দিয়ে টাকা আদায়ের ‘শিকার’ হয়ে বিব্রত হয়েছি, হয়তো বা বিরক্তও। কিন্তু আমরা কয়জন জানি এই মানুষগুলোর জীবন কী ভয়ংকর বিভীষিকাময়!

এরপর সেই নুরি কোনও প্রয়োজনে আসতো; সঙ্গে কখনও কখনও আরও ২/১ জন সঙ্গী থাকতো, যাদের নাম ফিরোজা, তাহেরা। কিছু দিন না যেতেই আমি যে বাসায় ভাড়া থাকতাম সেই বিল্ডিংয়ের সব ভাড়াটিয়া বাড়িওয়ালার কাছে আমার বিরুদ্ধে নালিশ করেছে এই বলে যে আমার কারণে বিল্ডিংয়ে ‘হিজড়া’দের আনাগোনা, এটা বন্ধ করতেই হবে। নানাভাবে বুঝিয়েও পারিনি – অবশেষে আমার বাসায় নুরি, ফিরোজা, তাহেরাদের আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

আমি জানি মাঝে-মাঝেই নতুন জন্ম নেওয়া শিশুর খোঁজ পেলে তারা বাসায় এসে রীতিমত ‘ঠ্যাক’ দিয়ে টাকা নিয়ে যায়। তারা দোকান থেকে টাকা তুলতে চাপ প্রয়োগ করে। আর ইদানীং তো রাস্তায়ও তারা মানুষের কাছ থেকে টাকা চায়। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এই ক্ষেত্রে অবশ্য তারা তেমন চাপ দেয় না। কিন্তু এতেই আমরা তাদের ওপর এতটা ক্ষুব্ধ-বিরক্ত-ক্রুদ্ধ? এতটা ঘৃণা আমাদের তাদের প্রতি? এই সমাজের মানুষ তো তাদের জীবিকা দেয় না, তাই এভাবে টাকা না পেলে তারা বাঁচবে কী করে? নাকি আমরা মনে করি তাদের মরে যাওয়াই উচিত?

আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার পরিচিতদের মধ্যে ট্রান্সজেন্ডারদের সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি কেমন সেটা দেখার চেষ্টা করেছি। আমি দেখলাম প্রায় সবার কাছে এরা অত্যন্ত ভীতিকর, বিরক্তিকর। কেউ ওদের ‘পাল্লায়’ পড়েছেন, কেউ অন্যদের ওদের ‘পাল্লায়’ পড়তে দেখেছেন, আর কেউ বা অন্যদের কাছে শুনেছেন ওদের ‘ভয়ংকর’ এবং ‘নোংরা’ আচরণের কথা।

অথচ আমরা কয়জন একটু ভেবে দেখেছি যে এই মানুষগুলো কতটা দুঃখী। সম্ভবত আমাদের দেশের সবচেয়ে দুর্ভাগা মানুষ এরা। এই দেশের এই সমাজে একজন শারীরিক/মানসিক প্রতিবন্ধী, স্কিজোফ্রেনিক মানুষের অবস্থাও ভালো নয়, তবে তাদেরও একটা অবস্থান আছে; কিন্তু ন্যূনতম কোনও সামাজিক অবস্থান নেই ট্রান্সজেন্ডারদের।

নজরুল ইসলাম ঋতুকে এই সমাজ গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করেছে, কিন্তু মাটির টান তিনি ভুলে থাকতে পারেননি। গত ১৫ বছর তিনি গ্রামে ফিরে ফিরে গেছেন বারবার। মানুষের নানা প্রয়োজনে তিনি তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিশেষ করে করোনার সময়ে তার মানুষের পাশে দাঁড়ানোটা তাকে নিয়ে গেছে মানুষের সবচেয়ে কাছাকাছি। নির্বাচনি প্রচারণার সময় নানা বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। নৌকার বিরুদ্ধে নির্বাচন করতে যাওয়া আর সব বিরোধী প্রার্থীর মতো তিনি মুখোমুখি হয়েছেন তীব্র বিরোধিতার। তার পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে, প্রচারণায় বাধা দেওয়া হয়েছে, এমনকি শারীরিকভাবে হামলার শিকার হয়েছেন তার অনেক কর্মী। কিন্তু সবচেয়ে মর্মান্তিক যেটি সেটি হয়েছিল তার লৈঙ্গিক পরিচয়কে ভিত্তি করে। শোনা যাক তার জবানিতেই-

‘আমার পরিচয় নিয়ে নানা কথা হয়েছে। আমি হিজড়া, আমাকে ভোট দিলে কোনও কাজ করতে পারবো না। এলাকায় থাকতে পারবো না। আমি কী সেবা করবো, আমার তো চেয়ারম্যান বা এসব বিষয় নিয়ে কোনও ধারণাই নেই —এসব নানা প্রচারণা হয়েছে। অনেক লাঞ্ছনা সহ্য করেছি। হিজড়া না হলে এমন করে হয়তো কেউ বলতে পারতো না’।

ঋতুর আগে, আরেকজন ট্রান্সজেন্ডার তাসনুভা একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে সংবাদ পাঠ করার জন্য নিয়োজিত হয়েছেন। সেটা নিয়েও আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। নিশ্চিতভাবে এটি একটি বড় ঘটনা। কিন্তু এখানে লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, তার নিয়োগ নিশ্চিত হয়েছে একটি প্রতিষ্ঠানের অল্প কয়েকজন মানুষের সিদ্ধান্তের ফলে।

সেই তুলনায় ঋতু যা করেছেন তার গুরুত্ব অনেক বড়। একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে হাজার হাজার মানুষ তাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন। ঋতুর সঙ্গে নির্বাচন করা নৌকার প্রার্থী ভোট পেয়েছেন তার অর্ধেকেরও কম। ঋতুর জয় কতটা সাধনার মধ্য দিয়ে এসেছে, সেটা কিছুটা হলেও অনুমান করতে পারি আমরা। দেশের একটি প্রত্যন্ত জেলা ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের প্রত্যন্ত ইউনিয়ন ত্রিলোচনপুরের নেহায়েত ‘গেঁয়ো’ মানুষরা অংশ হলেন এই বিপ্লবের। সেই মানুষদেরও স্যালুট জানাই।

আমাদের দেশে হিজড়াদের পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার আইনি অধিকারও নেই। ওদের কি আমরা ‘মানুষ’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করি না?

একটি শিশু তার ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসে না, আসে বাবা-মায়ের ইচ্ছায়। তাই একটি লৈঙ্গিক ভিন্নতাসম্পন্ন শিশু তার পরিবারে যদি ন্যূনতম অনাদর-অবহেলার শিকার হয়, তাহলে সেটা পরিবারের ভয়ংকর অপরাধ। এর জন্য সেই পরিবার সমাজ, সংস্কার কোনও কিছুকেই কারণ হিসেবে দেখাতে পারে না। তারপরও বলতে চাই, তেমন মানুষের পরিবারগুলো এমন হয়ে ওঠার পেছনে আমাদের ভূমিকা অনেক বড়। আমরা যদি এই মানুষগুলোর প্রতি সম্মান রাখতাম, নিদেনপক্ষে সহনশীল হতাম, তাহলে পরিস্থিতি এত ভয়ংকর হতো না।

প্রগতির বিচারে আমাদের সমাজ ক্রমাগত পেছনের দিকে হাঁটছে বলে আমার ধারণা। কোনও রকম ভিন্নতা আমরা সহ্য করি না- হোক সেটা দলের ভিন্নতা, মতের ভিন্নতা কিংবা লিঙ্গের ভিন্নতা। এমন একটা সমাজে ঋতুর জয় ভীষণ আনন্দের। কামনা করতেই পারি, এটা যেন পথ দেখায় অন্য ‘হিজড়া’দের সমাজের মূলধারায় ফিরে আসতে। কিন্তু এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা তাদের না, আমাদের। কারণ, তারা সমাজের মূলধারা থেকে স্বেচ্ছায় বেরিয়ে যাননি, আমরা বর্বরভাবে স্রেফ ‘খেদিয়ে’ দিয়েছি তাদের।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

বাংলা ট্রিবিউন

সর্বাধিক পঠিত


ভিডিও